ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

খরাপ্রবণ অঞ্চলে ‘কৃত্রিম বৃষ্টিধারা’ সেচের পরিকল্পনা

মফিজুল সাদিক | প্রকাশিত: ০৯:১৭ এএম, ১২ মার্চ ২০২৪

জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা পানির ৯০ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। ঢাকার পর দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে দ্রুত নামছে পানির স্তর। ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে উত্তরবঙ্গের ৭৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে ঝরনা সেচ পদ্ধতি বা কৃত্রিম বৃষ্টিরধারা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।

এই সেচ পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যকরী একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে ব্যবহার একেবারেই কম। শুধু চা বাগানে এ পদ্ধতিতে আগে থেকেই পানি দেওয়া হয়। ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে স্প্রিংকলার নামক যন্ত্র দিয়ে বৃষ্টির মতো করে এই ছিটানো হয় পানি। বাগান কিংবা ধানক্ষেতে ১৫০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত দুদিকে বৃষ্টি ধারার মতো পানি ছিটানো যায় এটা দিয়ে। বড় বাগান ও ফসলি ক্ষেতে স্প্রিংকলার দিয়ে পানি দেওয়া সহজ। স্প্রিংকলার ব্যবহার করে ৩৬০ ডিগ্রি বলয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট দূরত্বে ঘণ্টায় চার থেকে ১৬শ লিটার পানি ছিটানো যায়।

সেচে কৃত্রিম বৃষ্টিধারা বা ঝরনার মতো সেচ পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। বিষয়টি আমাদের দেশে সম্ভব কি না সমীক্ষা করে দেখবো। এটাসহ নানা বিষয় মাথায় রেখেই সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।- বাপাউবোর মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা

‘উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হালনাগাদকরণ এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় বিদ্যমান হালকা সেচ প্রকল্পগুলোর পুনর্বাসন কাজের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে এভাবে সেচের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। বাপাউবো থেকে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকার একটি সমীক্ষা প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠালে সম্প্রতি পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। কমিশনে প্রস্তাব করা হয় কৃত্রিম বৃষ্টিধারা সেচ পদ্ধতি চালুর বিষয়ে। এতে একমত প্রকাশ করে কমিশন। বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব কি না সমীক্ষা করবে বাপাউবো।

আরও পড়ুন
‘ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে দেশ মরুকরণের দিকে যাবে’
দিনাজপুরে প্রতি বছর ৭-৮ ফুট নিচে নামছে পানির স্তর
নামছে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি
ঢাকা ও বরেন্দ্র এলাকায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর

২০২৩ সালে ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক একটি গবেষণা হয়। এতে উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে পানি সংকটাপন্ন এলাকা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুটে।

খরাপ্রবণ অঞ্চলে ‘কৃত্রিম বৃষ্টিধারা’ সেচের পরিকল্পনা

খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ২০২১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট। এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ছয় ও নাচোলের চার ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা।

ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে চায় বাপাউবো। সেচে কৃত্রিম বৃষ্টিরধারা প্রসঙ্গে বাপাউবোর মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সেচে কৃত্রিম বৃষ্টিধারা বা ঝরনার মতো সেচ পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। বিষয়টি আমাদের দেশে সম্ভব কি না সমীক্ষা করে দেখবো। এটাসহ নানা বিষয় মাথায় রেখেই সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।’

স্ট্যাডি প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে গঙ্গা-কপোতাক্ষ, গড়াই ও ইছামতি নদীর পানির পর্যাপ্ততার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তা নিরূপণ করতে বলেছে কমিশন। পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণ কমাতে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ক্যানেল থেকে বারিড পাইপ সিস্টেমের মাধ্যমে সেচ সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

প্রকল্পটিতে প্রায় ৭৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে সরাসরি গ্রাভিয়েশন ফোর্সের মাধ্যমে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে কি না এবং সে অনুযায়ী উন্মুক্ত প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেচনালা নির্মাণের সংস্থান রাখা হবে। বর্তমানে বরেন্দ্র এলাকায় সেচ কার্যক্রম প্রায় ৯০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর। ফলে এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।- পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মপ্রধান (সেচ) মহা. এনামূল হক

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মপ্রধান (সেচ) মহা. এনামূল হক বলেন, ‘প্রকল্পটিতে প্রায় ৭৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে সরাসরি গ্রাভিয়েশন ফোর্সের মাধ্যমে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে কি না এবং সে অনুযায়ী উন্মুক্ত প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেচনালা নির্মাণের সংস্থান রাখা হবে। বর্তমানে বরেন্দ্র এলাকায় সেচ কার্যক্রম প্রায় ৯০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর। ফলে এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র এলাকায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে ইন্টিগ্রেটেড ইরিগেশন ডিজাইন সমীক্ষার কার্যপরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।’

খরাপ্রবণ অঞ্চলে ‘কৃত্রিম বৃষ্টিধারা’ সেচের পরিকল্পনা

তিনি বলেন, ‘বারিড পাইপের মাধ্যমে পানির পরিবহন দক্ষতা প্রায় ৯৫ শতাংশ। এছাড়া বাপাউবো ও বিএমডিএর যৌথ ব্যবস্থাপনায় বারিড পাইপ স্থাপনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদনের সময় বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে একদিকে জমিতে পানি পৌঁছানো যেমন সহজ হবে, তেমনি একই সঙ্গে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। সার্বিক বিবেচনায় প্রকল্পটি গ্রহণ করা যেতে পারে।’

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বিগত ৩০ বছরে পদ্মা নদীর ঋতুভিত্তিক নাব্যসীমা, গভীরতা ও প্রবাহিত পানির পরিমাণ বিশ্লেষণসহ প্রকল্পের জীবনকালে ঋতুভিত্তিক পানির চাহিদার বিশ্লেষণ সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এ প্রকল্পের জন্য পানি উত্তোলনের ফলে শীতকালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, গড়াই নদীর প্রবাহ এবং পাবনা জেলার ইছামতি নদী পুনঃরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্পের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তা যাচাই করতে হবে। ২০০৬ সালে হালনাগাদ করা সমীক্ষায় এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

২০০৬ সালের পর বিএমডিএ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে ভূ-উপরিস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ কাজে ব্যবহার করে সেচ এলাকা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রকল্প এলাকাধীন নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন এবং সেচ কার্যক্রমের পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য উৎপাদন ও পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে তাও সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করায় জোর দিয়েছে কমিশন।

বাপাউবো জানায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় সেচ সুবিধার জন্য এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় বিদ্যমান হালকা সেচ প্রকল্প পুনর্বাসনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সমীক্ষাটি সম্পাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সমীক্ষা প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা এবং মেয়াদকাল দুই বছর।

খরাপ্রবণ অঞ্চলে ‘কৃত্রিম বৃষ্টিধারা’ সেচের পরিকল্পনা

প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য প্রকল্প এলাকায় সেচ সুবিধার লক্ষ্যে পরিবর্তিত ভূমি ব্যবহারের ধরন ও বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের পূর্ববর্তী সমীক্ষাটি হালনাগাদকরণ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় বিদ্যমান হালকা সেচ প্রকল্পগুলোর অবকাঠামো ডিজাইন প্রণয়ন, পরিবেশ ও সামাজিক সমীক্ষাপূর্বক প্রকল্প এলাকার কৃষি উন্নয়ন ও পরবর্তী বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর ব্যয় প্রাক্কলন করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রস্তুতকরণে সহায়তা করা।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ পরিহার করে বিদ্যমান খালগুলো ইরিগেশন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যায় কি না এবং জলাশয়গুলো (বিল) রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না তা যাচাই করা প্রয়োজন। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান সেচ খাল ও জলাশয়গুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

এমওএস/এএসএ/এএসএম