বাংলাদেশের ব্যাংকিং কেলেঙ্কারি
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যায়। এর মধ্যে মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি অর্থ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এখনও পর্যন্ত এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা। তবে এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি যে কে বা কারা এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বা টাকাগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে। খবর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি ডলার চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। আর এজন্য ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর অনিয়মই দায়ী।
বাংলাদেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট অর্থের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারের অধীনে থাকার কারণে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাবও অনেক বেশি।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনার সঙ্গে জড়িত দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংক। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এই ব্যাংকের একটি শাখা থেকে অবৈধভাবে ৫৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঋণ দেয়া হয়। ঢাকা ট্রিবিউনের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেয়া হয় টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান হলমার্ককে। হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির মাহমুদ শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগসূত্রের মাধ্যমে কাল্পনিক একটি কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। এই কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ার পরও সোনালী ব্যাংক অলস ঋণের অনুপাত অতিমাত্রায় রেখেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
২০১৪ সালে অলস ঋণের অনুপাত ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকসহ বাংলাদেশের অন্য পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়মিতভাবে সরকারের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে থাকে। ২০১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ডলার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ২০০৮-২০১১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। তিনি ব্যাংকিং খাতের বেশ কিছু নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে বলেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতায় ব্যাংকের পরিচালকরা যেসব ঋণ অনুমোদন করেন, তার সবগুলোই খেলাপিতে পরিণত হয়।
ঋণখেলাপির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন বাংলাদেশে ওষুধ ও পোশাকশিল্প রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমান। তিনি বাংলাদেশের সম্পদশালী ব্যক্তিদের একজন। ২০০৭ সালে ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি বার্তা ও পরবর্তীকালে উইকিলিকসে প্রকাশিত নথিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপিদের মধ্যে একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয় সালমান এফ রহমানকে। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতারণার জন্য তাকে সাজা ভোগ করতে হয়েছিল।
২০০৯-১২ সালে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার লুট করা হয়। ওই ঘটনায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এই কেলেঙ্কারির তালিকায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে থাকলেও তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ওই ঘটনাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো রাজনীতিবিদদের হাতের পুতুল।
২০১৩ সালে প্রায় ৯শ ৭০ কোটি ডলার সমমূল্যের অবৈধ সম্পদ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়। ওই অর্থ ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া বিদেশি উন্নয়ন সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রাপ্ত অর্থের ৩ দশমিক ৫ গুণই পাচার হয়ে গেছে।
এসব অর্থ জালিয়াতি রোধ করতে ব্যাংকগুলোকে সচেষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ, আইনি কাঠামো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু যারা এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তারা ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনতে চায় না। তাই এক্ষেত্রে সরকারকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
টিটিএন/আরআইপি