শঙ্কা-অনিশ্চয়তা
বাংলা ভাষা-উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে বিহারি ক্যাম্পের তরুণদের
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প। অনেকের কাছে এটি ‘বিহারি ক্যাম্প’ নামেও পরিচত। এ ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। ক্যাম্পে প্রবেশ করলেই মনে হয় ভারতের হিন্দিভাষী অথবা পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করেছি। এই বিহারি ক্যাম্পেও স্থানীয়রা সাধারণত হিন্দি অথবা উর্দু ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেক্ষেত্রে প্রবীণদের সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ক্যাম্পের তরুণরা শিক্ষাদীক্ষায় যেমন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। তবে শিক্ষিত হয়েও চাকরির ক্ষেত্রে তাদের শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সমাজের মূলস্রোতেও এখনো পুরোপুরি আসতে পারেনি তারা।
ক্যাম্পের ভেতরে জামা-কাপড়ের দোকান নিয়ে বসে আছেন উজ্জ্বল হোসেন। এইচএসসি পাস করেই নিজে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যেটুকু পড়ালেখা সেটাও করেছেন নিজের চেষ্টায়। তার দোকানেই আড্ডা দিচ্ছিলেন ক্যাম্পের আরও দুই যুবক আবু সায়েম ও আলামিন। সায়েম সেলুনে কাজ করে মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আলামিন মোটরসাইকেল মেকানিক।
সেখানেই জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কথা হয় উজ্জ্বল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিজের উদ্যোগে পড়ালেখা করেছি। কিন্তু চাকরি পাইনি। অনেকে যখন বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে তখন বিহারী ক্যাম্পের নাম শুনে আর চাকরি দিতে চায় না। অনেকে আমাদের বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের প্রতি তাদের এমন মনোভাব কেন, জানি না।
একুশ আমাদের প্রেরণা, একুশ আমাদের অহংকার। ভাষার মর্যাদা রক্ষার এ দিনটি পালন করছেন বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দারাও। ক্যাম্পের বাসিন্দা সাহিনা খানম। তার একমাত্র ছেলে আহনাফ হোসেন এদিন সকাল সকাল মোহাম্মদপুর বালক বিদ্যালয়ে চলে যায়, ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে
বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনের ও ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। দিনটি এতটাই স্মরণীয় যে শুধু ‘একুশে’ বললেই আমরা ধরে নিই একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বলা হচ্ছে। একুশ আমাদের প্রেরণা, একুশ আমাদের অহংকার। ভাষার মর্যাদা রক্ষার এ দিনটি পালন করছেন বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দারাও। ক্যাম্পের বাসিন্দা সাহিনা খানম। তার একমাত্র ছেলে আহনাফ হোসেন এদিন সকাল সকাল মোহাম্মদপুর বালক বিদ্যালয়ে চলে যায়, ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
সাহিনা বেগম বলেন, আমি বাংলাদেশি এটিই আমার পরিচয়। আমি এদেশে জন্মেছি, আমার ছেলেও এদেশে জন্মেছে। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো ঠিকানা আমাদের নেই। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে বড় অফিসার বানাবো। কিন্তু অনেকে আমাদের বিশ্বাস করে না, কেউ ভালো চাকরিও দিতে চায় না।
এদিন সরেজমিনে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর বিহারী ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে একাধিক পরিবার নিয়ে বাস করছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। সেখানে পানির অপর্যাপ্ততা, শৌচাগার ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। বর্ষায় তাদের দুর্ভোগ আরও বেশি হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরে পানি ওঠে, সেই পানি সহজে নামতেও চায় না। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় ঘরের ভেতরে হাঁটু সমান পানি ঢেউ খেলে। সেখানেই কাটে তাদের দিন-রাত।
ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের কথা যেন আর ফুরোয় না। বিড়ম্বনা ও দুর্বিষহ জীবনের মুহূর্তগুলো একে একে বলতে থাকেন সেখানকার বাসিন্দারা। ক্যাম্পের ভেতরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এতোটাই নাজুক প্রবেশ করলেই দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে একাধিক সদস্যের বসবাস, প্রাইভেসি বলতে কিছুই নেই সেখানে।
আমি বাংলাদেশি এটিই আমার পরিচয়। আমি এদেশে জন্মেছি, আমার ছেলেও এদেশে জন্মেছে। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো ঠিকানা আমাদের নেই। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে বড় অফিসার বানাবো। কিন্তু অনেকে আমাদের বিশ্বাস করে না, কেউ ভালো চাকরিও দিতে চায় না
কথা হয় সেখানকার ক্যাম্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও। তারা জানান তাদের নিদারুণ কষ্টের কাহিনী এবং পাকিস্তান সরকারের অঙ্গীকার ভঙ্গের বেদনার কথা আর বাংলাদেশ সরকার তাদের স্থায়ী নাগরিকের পরিচয়পত্র দিলেও সেটির ব্যবহারে বিভিন্ন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা। ক্যাম্পের তরুণরা পড়ালেখা করতে ইচ্ছুক, কিন্তু আর্থিক সংকটে অনেকেরই সেটি হয়ে ওঠে না। ফলে অনেক তরুণ বাধ্য হয়ে সেলুনে বা হোটেলে কাজ করেন। অনেকে বাসের হেলপার বা রিকশা চালিয়ে পরিবারকে সহায়তা করেন।
ক্যাম্পের প্রবীণ বাসিন্দারা সাধারণত হিন্দি বা উর্দুতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও তরুণদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেছে। উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে বাড়ছে বাংলা ভাষার প্রতি মমতা।
বিহারী ক্যাম্পের মধ্যে রয়েছে ওব্যাট এনএলজি হাইস্কুল। সেখানে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। ঢাকা বোর্ডের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান হয়। তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শওকত আলী।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা বোর্ডের কারিকুলাম অনুযায়ী আমরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করি। অনেক শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে বা স্মৃতিসৌধে যায়। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অনেক প্রেম। তাদের মধ্যে কষ্টও আছে। পড়ালেখা করলেও অনেকে ক্যাম্পের ছেলে-মেয়েদের চাকরি দিতে চায় না। এমন ঘটনাও আছে চাকরি ফাইনাল, যখন জানতে পারে ক্যাম্পের বাসিন্দা তখন আর চাকরি হয় না। তাই অনেক শিক্ষিত ছেলে বাধ্য হয়ে সেলুনে কাজ করে, কেউ আবার ছোটখাটো ব্যবসা করে। তাদেরই কেউ কেউ বিপথগামী হয়ে মাদকে জড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পের বাসিন্দাদের প্রধান সমস্যা আর্থিক অনটন। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেই ক্যাম্পের অনেক তরুণ উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। অনেকে রাতে কাজ করে দিনে পড়ালেখা করছে।
বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অনেক প্রেম। তাদের মধ্যে কষ্টও আছে। পড়ালেখা করলেও অনেকে ক্যাম্পের ছেলে-মেয়েদের চাকরি দিতে চায় না। এমন ঘটনাও আছে চাকরি ফাইনাল, যখন জানতে পারে ক্যাম্পের বাসিন্দা তখন আর চাকরি হয় না। তাই অনেক শিক্ষিত ছেলে বাধ্য হয়ে সেলুনে কাজ করে, কেউ আবার ছোটখাটো ব্যবসা করে। তাদেরই কেউ কেউ বিপথগামী হয়ে মাদকে জড়িয়ে পড়ে
স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানী জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটির (এসপিজিআরসি) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনা, খুলনা, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী) ৭০টি বিহারী ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পে আট লাখের বেশি উর্দুভাষী বিহারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানকালে ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। যার একটি অংশ ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তানেরও আবার দুটি অংশ হয়, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ওই সময়কালে জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ফলে ধর্মীয় আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান থেকে বহু হিন্দু ও শিখ ভারতে এবং ভারত থেকে বহু মুসলমান পাকিস্তানে পাড়ি জমান। তখন ১০ লাখ, মতান্তরে ১৩ লাখ মুসলমান ভারতের বিহার, পশ্চিম বাংলা, আসাম, ওড়িশা, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা ও সিকিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।
এসপিজিআরসির সভাপতি শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সব ক্যাম্পেই তরুণেরা কষ্ট হলেও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আগ্রহও বেশি। স্থানীয় সংসদ সদস্য নানক সাহেব (বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক) ক্যাম্পের অনেক শিক্ষিত ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আমাদের ক্যাম্পের সন্তানদের নিজের সন্তান মনে করে চাকরি দিন। ওদের একটু ভালোভাবে বাঁচতে সহায়তা করুন।
এমওএম/এমকেআর/জেআইএম
সর্বশেষ - জাতীয়
- ১ গুমের সঙ্গে জড়িত সেনা-পুলিশের ২০ কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
- ২ শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে ৫ কর্মকর্তা নিয়োগ
- ৩ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কায়রোতে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সাক্ষাৎ
- ৪ রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের হাসিমুখে বরণ করুন: রাষ্ট্রদূত মুশফিক
- ৫ কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে