ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

গুলশানের বাড়ি হারাতে পারেন সালাম মুর্শেদী

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৬:২০ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

গুলশানে অবস্থিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি বাড়ি দখলের অভিযোগ ওঠা খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে মামলায় আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী এ ব্যবসায়ীকে বাদ দিয়ে রাজউকের সাবেক দুই চেয়ারম্যানসহ ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেছে দুদক।

সালাম মুর্শেদীর দাবি, গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি বাড়িটির তিনি ক্রয়সূত্রে মালিক। অন্যদিকে বাড়িটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ও তা মুর্শেদী দখল করেছেন, এমন অভিযোগ এনে আদালতে রিট করেন ব্যারিস্টার সুমন। এরপর আদালতের আদেশে অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান বলছে, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মুর্শেদীর কাছে বাড়িটি বিক্রি করা হয়েছিল। এর ফলে বাড়িটি কেনার ক্ষেত্রে জালিয়াতির দায় তিনি (মুর্শেদী) এড়াতে পারেন না। তারপরও ‘অদৃশ্য’ কারণে সালাম মুর্শেদীকে এ মামলায় আসামি করা হয়নি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, আসামি না হলেও বাড়িটির মালিকানা ছাড়তে হতে পারে মুর্শেদীকে। এরই মধ্যে বাড়িটি উদ্ধারে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছে দুদক।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পত্তিটির মালিকানা সৃজন করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। জাল কাগজ সৃজন করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন করে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বিধায় বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কমিশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

আরও পড়ুন>> একজন এমপি হয়ে আরেক এমপির বিরুদ্ধে লড়ছি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়িটি জালিয়াতিপূর্ণভাবে বিক্রি করা হয়েছে, এ তথ্য জানার পরও সেটি কেনায় সালাম মুর্শেদীকে মামলার চার্জশিটে আসামি করা যাবে। তবে চার্জশিটে আসামি করা না হলে আদালত তার নাম চার্জশিটভুক্ত করতে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন। যদিও এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে চাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

আর এ বিষয়ে দুদক সচিবকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তথ্য আমাকে জেনে জানাতে হবে। আমার কাছে এখন কোনো তথ্য নেই।

গত ৫ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাত বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ ১১ আসামির নামে মামলাটি দায়ের করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিরা হলেন রাজউকের সাবেক দুই চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম ও প্রকৌশলী এম আজিজুল হক, রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট) এম নুরুল হক, সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবহান, সাবেক পরিচালক (এস্টেট) আবদুর রহমান ভূঁঞা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক শাখা সহকারী মো. মাহবুবুল হক।

এছাড়া রাজউকের মোহাম্মদ হাসান, মীর মো. নুরুল আফছার, রাজউকের সাবেক নিম্নমান সহকারী-কাম-মুদ্রাক্ষরিক, বর্তমানে সহকারী পরিচালক (নিরীক্ষা ও বাজেট) শাহ মো. সদরুল আলম, রাজউকের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক-৫ মো. হাবিব উল্লাহ ও রাজউকের সাবেক উপ-পরিচালক (এস্টেট) মো. আজহারুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন>> ফিফার দেওয়া অর্থে কেনাকাটা হয়েছে, দুর্নীতি হয়নি

সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানে আব্দুস সালাম মুর্শেদীসহ অন্যদের সংশ্লিষ্টতা থাকার সত্যতা পাওয়া গেলে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি মুর্শেদীসহ অন্য আসামিদের নামে মামলা দায়েরের জন্য কমিশনে সুপারিশ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেয় দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান দল। তবে শেষ মূহুর্তে তার নাম বাদ যায়।

যেভাবে বাড়িটি কিনলেন মুর্শেদী

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সম্পত্তিটি ১৯৬০ সালে ঢাকা রি-রোলিং মিলস এর নামে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি, বর্তমানে রাজউক) বরাদ্দ প্রদান করে। ১৯৭০ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ঢাকা রি-রোলিং মিলসের মালিকরা পাকিস্তানি হওয়ায় দেশ ত্যাগ করেন। সেই সুযোগে মো. ওয়াছিউর রহমান নামে এক ব্যক্তি রি-রোলিং মিলসের অ্যাটর্নি হিসেবে নিজেকে দাবি করেন। প্লটটিতে অবৈধভাবে দখলপূর্বক বসবাস শুরু করেন।

ওয়াছিউর রহমান ১৯৭২ সালের জুনে ডিআইটিতে আবেদন করে প্লটটি তার স্ত্রী মিসেস মালেকা রহমানের নামে ক্রয় করা হয়েছে বলে জানান। আবার একই বছরের সেপ্টেম্বরে পৃথক আবেদনে ওয়াছিউর জানান, তিনি ঢাকা রি-রোলিং মিলসের নিকট হতে প্লটটি নিজে ক্রয় করেছেন। যা বিপরীতমুখী এবং বিভ্রান্তিমূলক। রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-১ শাখায় রক্ষিত গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি)- ২৭ এর বিভাজনকৃত প্লট সিইএন (ডি)- ২৭/বি এর রক্ষিত ফটোকপি নথিতে ১৯৬৯ সনের বিক্রয় চুক্তিনামার সত্যায়িত কপিতে ঢাকা রি-রোলিং মিলসের সঙ্গে মিসেস মালেকা রহমানের বিক্রয় চুক্তি (রেজিস্ট্রিকৃত নয়) এবং পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সত্যায়িত কপিতে প্লটটির বিপরীতে ঢাকা রি-রোলিং মিলসের অংশীদারদের পক্ষে আইনগত অ্যাটর্নি মি. সফিক আহমেদকে দেখা যায়। যদিও আইনগত অ্যাটর্নি হিসেবে তার দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

‘আলোচ্য আবেদন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও বিক্রয় চুক্তিনামা কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বরাদ্দ গ্রহীতার পক্ষে একাধিক অ্যাটর্নি বিদ্যমান, একদিকে অ্যাটর্নি সফিক আহমেদ এবং অন্যদিকে মো. ওয়াছিউর রহমান। একই প্লট ৬ (ছয়) বছর পর ১৯৭৫ সালে ঢাকা রি-রোলিং মিলসের অ্যাটর্নি হিসেবে মো. ওয়াছিউর রহমান তার স্ত্রী মিসেস মালেকা রহমানের সঙ্গে পুনঃবিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করেন। মিসেস মালেকা রহমানের নামে ওই প্লটটি ভুয়ারেকর্ডপত্র তৈরি করে মো. ওয়াছিউর রহমান এবং তৎকালীন ডিআইটির অসাধু কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত চুক্তিনামা সম্পন্ন এবং নামজারীকরণের মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন।

এজাহারে বলা হয়, রাজউকের নথিতে দেখা যায় ১৯৬০ সাল থেকে মো. ওয়াছিউর রহমানের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত সব রেকর্ডপত্রে প্লটটিকে গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি) ব্লকের ২৭ নং প্লট হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে, রোড নম্বর দিয়ে নয়। প্লটের লিজ দাবিদার মিসেস মালেকা রহমান ১৯৮৬ সালে প্লটটি ইমারতসহ তার পুত্র নুরুল আজিমকে দানসূত্রে হস্তান্তর করার জন্য আবেদন করলে প্লটটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে মর্মে রাজউক থেকে জানিয়ে প্রত্যাখান করা হয়।

এরপর মিসেস মালেকা রহমানের পুত্ররা গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জাল কাগজপত্র সৃজন করে বাড়িটি আত্মসাৎ করেন। মিসেস মালেকা রহমানের পুত্রদ্বয় মীর মোহাম্মদ হাসান এবং মীর মো. নুরুল আফসার ১৯৯৬ সালে প্লটটি আত্মসাৎ করেন।

পরবর্তীসময়ে সুকৌশলে ১৯৯৭-৯৮ সালে তারা আবদুস সালাম মুর্শেদীর নিকট বাড়িটি বিক্রয় করেন। প্লটের দাবিদার মিসেস মালেকা রহমানের স্বাক্ষর জাল করে প্লটটি দানপত্রমূলে তার ছেলেদ্বয় কর্তৃক লিখে নেওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তিনি তার ২ পুত্রসহ প্লটের বর্তমান সুবিধাভোগী এবং ভোগদখলকারী আব্দুস সালাম মুর্শেদী, মিসেস ইফফাত হক এবং মোহাম্মদ আবদুল মঈনকে বিবাদী করে আইনগত প্রতিকার প্রার্থনা করে ঢাকা ১ম সাব জজ আদালতে মামলা করেন। যার রায় পর্যালোচনায় দেখা যায়, মিসেস মালেকা রহমান বিবাদী আব্দুস সালাম মুর্শেদী, মোহাম্মদ আবদুল মঈন এবং মিসেস ইফফাত হকের সঙ্গে ৬০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছোলেনামাসূত্রে সমঝোতা করেন। এছাড়াও, নথিতে প্রাপ্ত মালেকা রহমান ওরফে মালেকা বেগম তার বড় ছেলে এম এম হাসান ও মেজো ছেলে এম এম নুরুল আফছার বা অন্য কারো নিকট হেবা, দান, বিক্রয় বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করেননি।

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, আসামিরা প্রতারণার মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হওয়ার আশায় এবং অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকাশিত গেজেটে ‘খ’ তালিকাভুক্ত গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি)-২৭ নং, হোল্ডিং নং-২৯, রোড নং-১০৪ প্লটটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অবমুক্তকরণ ছাড়াই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা রেকর্ডপত্র তৈরি করে হস্তান্তর অনুমতি ও নামজারি অনুমোদন করার মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং আত্মসাতের সুযোগ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন>> সালাম মুর্শেদীর গুলশানের বাড়ি: অনুসন্ধান শেষ, প্রতিবেদন প্রস্তুত

এর আগে নথি জালিয়াতির মাধ্যমে সালাম মুর্শেদীকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয়– এমন অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বর্তমানে এমপি সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুদক অভিযোগটি আমলে না নেওয়ায় একই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ৪ জুলাই রাজউক চেয়ারম্যানকে দেওয়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিনটি চিঠি যুক্ত করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেওয়া চিঠিতে পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে বাড়িটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও সালাম মুর্শেদী কীভাবে সেটি দখল করে আছেন, রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে এ ব্যাখ্যা চেয়েছিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

২০২২ সালের ৪ জুলাই সালাম মুর্শেদীর গুলশানের বাড়িটি গণপূর্তের পরিত্যক্ত বাড়ি বলে দাবি করে রাজউককে চিঠি দেয় গণপূর্ত। তবে রাজউক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গণপূর্তের চিঠিতে বলা হয়, গুলশানের ১০৪ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়িটি পরিত্যক্ত বাড়ি। এটি সরকারি বাড়ি। গণপূর্তের মালিকানাধীন বাড়ি। অন্য কেউ এটা কাগজপত্র করে নিতে পারে না। কিন্তু রাজউক দলিল-দস্তাবেজ করে সালাম মুর্শেদীকে দিয়ে দিলো। অথচ এটির মালিকানা রাজউকের নয়। তাহলে রাজউক কীভাবে দিলো? বাড়িটি কীভাবে রাজউক হস্তান্তর করেছে, চিঠিতে রাজউকের কাছে তা জানতে চেয়েছে গণপূর্ত।

২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বাড়ি সংক্রান্ত মূল নথি ও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এক সপ্তাহের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অনুসন্ধান শেষ করে দুদক।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সালাম মুর্শেদীর আইনজীবী মো. সৈয়দ আহমেদুর রেজা জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে কমেন্ট (মন্তব্য) করতে আমাদের নিষেধ করা আছে। আদালতের আদেশ আছে, কোর্টের প্রসিডিংস ছাড়া কমেন্ট করতে নিষেধ আছে।

এসএম/এমএইচআর/এমএস