ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

রাজশাহী

মহাসড়কে আতঙ্ক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

সাখাওয়াত হোসেন | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৮:২৩ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মাজিদুল ইসলাম। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিন মোটরসাইকেলে যান কর্মস্থলে। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে গত মার্চ মাসে হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। এরপর দীর্ঘ ছয় মাস ছিলেন হাসপাতালে ভর্তি। এখন কোনোমতে দাঁড়াতে পারেন। হাঁটতেও পারেন কিছুটা। পুরো তিন মাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি। পূর্ণাঙ্গ সুস্থ হতে আরও তিনমাসের মতো সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

মাজিদুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্য সব দিনের মতোই আমি অফিসে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন একটু দেরি হয়ে গেছিল। দ্রুত অফিস ধরতে ফাঁকা রাস্তায় একটু বেশি জোরে বাইক চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশাপাশি দুটি ট্রাক একটি আরেকটিকে ওভারটেক করছিল। পাশে রাস্তা না থাকায় আমি মাটির রাস্তা পর্যন্ত নেমে আসি। তবে কাঁচা রাস্তায় নেমেও লাভ হয়নি। শেষ মুহূর্তে ট্রাকে লেগে আমার বাইক ধাক্কা খায় পাশের একটি গাছে। এতে মাথা ফেটে যায়। ভেঙে যায় হাত ও পা।’

তিনি বলেন, ‘অন্য সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলতে পারবো না। তবে আমি তো সঠিক নিয়মেই গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু ট্রাক আমাকে ধাক্কা মেরে দিলো। এখন আমি জীবন নিয়ে কোনোরকমে টিকে আছি।’

আমার যেটা মনে হয়, মাঠপর্যায়ে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ছেলেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালায়। আইন মানে না। একটু ভাব দেখাতে গিয়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এগুলো প্রতিরোধে আমরা সব সময় চেকপোস্ট পরিচালনা করছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স, বেপরোয়া ড্রাইভিং, তিনজন নিয়ে চলাচলকারী বাইকের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান।- রাজশাহী জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (অ্যাডমিন) আনোয়ার হোসেন

আরও পড়ুন>> সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে

মাজিদুলের মতে, রাজশাহীতে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেক মোটরসাইকেল আরোহী। গত এক বছরে জেলায় যত সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে তার বেশিরভাগই মোটরসাইকেলে। এর পরের অবস্থানেই আছে ট্রাক ও মাইক্রোবাস। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশা, থ্রি-হুইলার, ভটভটি প্রভৃতি তো আছেই।

পুলিশ বলছে, রাজশাহী জেলা ও মহানগর মিলে গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৮৩ জন ও আহত হয়েছেন ৮৮ জন। আর রাজশাহী মহানগর পুলিশের তথ্যমতে, রাজশাহী নগরীর ১২টি থানায় মহাসড়ক আছে মাত্র ২১ কিলোমিটার। বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হয় মহাসড়কে। বিশেষ করে রাজশাহী-কাটাখালী সড়ক ও রাজশাহী-নওগাঁ সড়কে।

মহাসড়কে আতঙ্ক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলরাজশাহীতে বেশিরভাগই দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলে। এর পরেই আছে ট্রাক ও মাইক্রোবাস।

রাজশাহী নগরীর ১২টি থানায় ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ৭০ জন। আহত হয়েছেন আরও ৪৭ জন। এসব ঘটনার মধ্যে ২৭টিই মোটরসাইকেলের। ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে ট্রাকের সঙ্গে। মাইক্রোবাসের সঙ্গে একটি।

রাজশাহী জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, রাজশাহী জেলায় মহাসড়ক রয়েছে মোট ৮৬ কিলোমিটার। জেলা পুলিশের অধীনে ৮টি থানা। এসব থানায় ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ১১৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১১৩ জন। আহত হয়েছেন ৪১ জন। এসব দুর্ঘটনাও অধিকাংশই ঘটেছে মোটরসাইকেলে। রাজশাহীর বেশিরভাগ সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল রীতিমতো আতঙ্কের নাম।

আরও পড়ুন>> ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ ১৬৭২ কিমি সড়ক, দুর্ঘটনা এড়াতে বসছে যন্ত্র

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতারা বলছেন, চালকের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না রাজশাহী অঞ্চলে। হাইওয়েতে নসিমন, করিমন, ভটভটি ভারী যানবাহন চলাচলে বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া মহাসড়কগুলোর ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ, দুই লেনের রোড, অনেক ক্ষেত্রে নেই ডিভাইডার- এসবই দুর্ঘটনার বড় কারণ। এছাড়া রাজশাহী মহসড়কে রয়েছে অর্ধশত ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। যেগুলোতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন এমন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীর তালাইমারি থেকে পুঠিয়া মহাসড়কে অন্তত ১৫ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এসব বাঁকে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে ওভারটেকিংয়ের সময় বাঁকগুলোতে সামনের গাড়ি দেখা যায় না। ফলে এখানে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত এক বছরে এ রুটে ৩০টিরও বেশি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ গত ২৫ নভেম্বর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর বাইপাস এলাকায় একটি ট্রাক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দিলে পাঁচজন নিহত হন।

রাজশাহীর সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি। বিগত কয়েক বছরে এটি বেড়েছে। আমরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছি। মোটরসাইকেল চালকরা ভালোমানের হেলমেট পরছে না। মোটরসাইকেল একটু সাবধানে চালালে ও পথচারীরা যদি একটু সচেতন হয় তবেই এ দুর্ঘটনা কমে আসবে।- নিরাপদ সড়ক চাই রাজশাহী জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৌফিক আহসান টিটু

রাজশাহী-নওগাঁ রুটে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে নওহাট থেকে কেশরহাট পর্যন্ত মহাসড়কে। এখানে অন্তত পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এ রুটে গত এক বছরে মারা গেছেন ২৩ জন। সকালে রাস্তার ওপর হাট-বাজার বসে। একই সঙ্গে থি-হুইলার চলার কারণে এখানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

আরও পড়ুন>> সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটে বছরে ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের হরিপুর থেকে বাসুবেদপুর পর্যন্ত এ সড়কটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে বড় বড় গাছ ও ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এ সড়কে গত এক বছরে মারা গেছেন ৪০ জন।

রাজশাহী-তানোর সড়কে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দুয়ারি থেকে তান্দুরা পর্যন্ত। এ সড়কে বড় ঝুঁকি সড়কটি প্রশস্ত নয়। পাশাপাশি সড়কটি থ্রি-হুইলারের দখলে। ফলে এখানে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এ সড়কে গত এক বছরে ১৫ জন মারা গেছেন।

রাজশাহী-বাগমারা সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ তাহেরপুর থেকে সালেহা কোল্ড স্টোরেজ পর্যন্ত। এ সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে অন্তত ১০টি। একই সঙ্গে এ সড়কের ওপর বাজার ও থ্রি-হুইলারের দখলের কারণে এখানে দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে গত এক বছরে ১০ জন মারা গেছেন।

মহাসড়কে আতঙ্ক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলরাজশাহীতে এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৮৩ জন ও আহত হয়েছেন ৮৮ জন।

বাঘা-চারঘাট সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ রুস্তমপুর বাজার থেকে বাউসা বাজার পর্যস্ত। এ সকড়টিতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে বেশি কয়েকটি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। পাশাপাশি রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা। এ সড়কে গত এক বছরে ১৫ জন নিহত হয়েছেন।

পুঠিয়া-দুর্গাপুর সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে পুঠিয়া থেকে ঝলমলিয়া মহাসড়কে। এ সড়কে রয়েছে একাধিক বাঁক। পাশাপাশি বড় গাছের কারণে সামনে দেখা যায় কম। ফলে রাতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। গত এক বছরে এখানে মোট ২২ জন মারা গেছেন।

দুর্ঘটনা বিষয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (অ্যাডমিন) আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার যেটা মনে হয়, মাঠপর্যায়ে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ছেলেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালায়। আইন মানে না। একটু ভাব দেখাতে গিয়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এগুলো প্রতিরোধে আমরা সব সময় চেকপোস্ট পরিচালনা করছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স, বেপরোয়া ড্রাইভিং, তিনজন নিয়ে চলাচলকারী বাইকের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান।

মহাসড়কে আতঙ্ক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলচালকের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না রাজশাহী অঞ্চলে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ডিসি অনির্বাণ চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা চলছে। আমরা স্পিডগানের মামলা দিচ্ছি। কাগজপত্র চেকিং হয়। জরিমানা করি। এগুলো করে যতটুকু পারি আমরা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিজের প্রাণের প্রতি আগে নিজেকে দয়া রাখতে হবে। এটি না হলে দুর্ঘটনা কমবে না।’

নিরাপদ সড়ক চাই রাজশাহী জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৌফিক আহসান টিটু জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজশাহীর সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি। বিগত কয়েক বছরে এটি বেড়েছে। আমরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছি। মোটরসাইকেল চালকরা ভালোমানের হেলমেট পরছে না।’

তিনি বলেন, ‘আইন না মেনে চলা, রাস্তার পাশে গরু বা অন্য পশু বেঁধে রাখাও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। এগুলো থেকে বাঁচতে আমাদের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও সচেতন করতে হবে। এছাড়া রাস্তা পথচারী ও বড় যানবাহনও একটু সচেতনভাবে চলা দরকার। আমাদের গবেষণা বলছে, ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটছে মোটরসাইকেলের কারণে। বাকি ৩০ শতাংশ পথচারীর রাস্তা পারাপারের সময়। এখন সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মানুষ মোটরসাইকেল একটু সাবধানে চালালে ও পথচারীরা যদি একটু সচেতন হয় তবেই এ দুর্ঘটনা কমে আসবে।

এএসএ/জেআইএম