লাখো প্রাণে মায়া ছড়াচ্ছে ‘অনেস্ট’
গল্পটি ভালোবাসার। গল্পটি মায়ার। গল্পের নায়ক সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা)। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাদল সৈয়দ হিসেবে পরিচিত। তার প্রায় সব লেখাই মানবতার, স্বপ্ন দেখানো আর মায়া ছড়ানোর। সবখানে একটি স্লোগান দেন তিনি, তা হলো- ‘আসুন মায়া ছড়াই’। একই স্লোগানে চট্টগ্রাম নগরের জামালখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘অনেস্ট সেন্টার’। একই ছাদের নিচে চার হাজার বর্গফুটের জায়গায় অনেস্ট সেন্টার সত্যি মায়া ছড়াচ্ছে লাখো প্রাণে।
অনেস্ট সেন্টারে রয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কন্ট্রোল রুম, অফ লাইন আউটলেট, ফ্রি জোন, অনেস্ট সুপারশপ, উন্মুক্ত লাইব্রেরি, এন্টিক প্রদর্শনী, প্যারেন্টস লাউঞ্জ ও অনেস্ট ক্যাফে। অনেস্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পছন্দের পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন যে কেউ। আবার সরাসরি অনেস্ট সেন্টারে গিয়েও পণ্য সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন>> স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁশের সাঁকো, ভোগান্তি কমলো এলাকাবাসীর
ফ্রি জোনে রয়েছে ‘গিভিং বউল’ সেবা। গিভিং বউলের মাধ্যমে যে কোনো দুস্থ পরিবারকে মুদিপণ্যের প্যাকেজ কিনে বিনামূল্যে দিতে পারেন। গিভিং বউল প্যাকেজে রয়েছে- পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, তেল, চিনি, আটা, এক প্যাকেট বিস্কুট ও একটি সাবান, যা দিয়ে একটি ছোট্ট পরিবার অনায়াসে এক সপ্তাহ চালিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া অনেস্ট সেন্টার থেকে মানসম্মত প্রত্যেক পণ্যই কিনতে পারেন বাজারের চেয়ে কম দামে।
উন্মুক্ত লাইব্রেরি
অনেস্ট সেন্টারের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে রয়েছে বইয়ের সমৃদ্ধ ভান্ডার। রয়েছে বিভিন্ন ক্লাসের বইও। যেখানে রয়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই। অনেস্ট ক্যাফেতে শিক্ষার্থীরা কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গ্রুপওয়ার্ক করার সুযোগ পান। অনেস্ট সেন্টারে এই সময়ে লাইব্রেরির বই বাদেও ক্লাসমেটরা নিজেরাও বই এনে গ্রুপওয়ার্ক করেন বিনা খরচেই। বই পড়া কিংবা গ্রুপওয়ার্কের সময়ে ক্লান্তি মেটাতে কফি-চকলেট কিনে খাওয়ার সুবিধা রয়েছে।
ক্যাফেতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা-আড্ডা
অনেস্ট ক্যাফে
এখানে একেক দিন একেকটি মেন্যু থাকে। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়েরাই এসব খাবার তৈরি করেন। সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অনেস্ট ক্যাফেটি থাকে লোকারণ্য। শিক্ষার্থীরাই থাকেন বেশি। তবে প্রতিদিনের মেন্যুতে ‘মায়া’ লেখা কফিটি পাওয়া যায়। সকাল থেকে কফি, পানি মিললেও মিষ্টি বা ঝালজাতীয় স্ন্যাক্স আইটেম পাওয়া যায় বিকেল ৪টা বা ৫টা থেকে।
এন্টিক প্রদর্শনী
পাশাপাশি আগে ব্যবহার হতো এখন তেমন হয় না, যেগুলো বর্তমান প্রজন্মের বাচ্চারা চেনেই না, পুরোনো এমন হরেক রকম যন্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেস্ট সেন্টারে। টাইপ রাইটার, পুরোনো দিনের ঘড়ি, হারিকেন, হ্যাজাক লাইট, রিল ক্যামেরা, রেডিও, ডায়াল টেলিফোনসহ নানান প্রাচীর সামগ্রী, যা এন্টিক প্রদর্শনী হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এন্টিক প্রদর্শনী
অনেস্ট সুপারশপ
অনেস্ট সুপারশপে রয়েছে সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে চাল, ডাল, চিনিসহ সব ধরনের শিশুখাদ্য। মানে বাজারে মুদিপণ্যের প্রায় সব আইটেম রয়েছে এখানে। রয়েছে শিশুসহ নানা বয়সীদের তৈরি পোশাক, জুতা, প্রসাধন সামগ্রী। অনেস্ট সুপার শপ থেকে যে কোনো পণ্য অনলাইনেও কেনা যায়। অনেস্ট কর্মীরাই এসব পণ্য গ্রাহকদের সরবরাহ করেন।
আরও পড়ুন>> পকেটে টাকা না থাকলেও পেটপুরে খাবার মেলে খোরশেদের হোটেলে
কথা বলতে চাইলে অনেস্টের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কেউ সরাসরি কথা বলতে চাননি। অনেস্টের ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেস্ট সেন্টারে ১৮-২০ জন ভলান্টিয়ার রয়েছেন। যাদের প্রায় সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা কোনো মাইনে পান না। তবে অনেস্ট তাদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দেয়।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় রয়েছেন অপারেশন ডিরেক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক। তিনি পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অন্যদিকে সিইও (প্রধান নির্বাহী) হিসেবে আছেন মঈনুল হক অপু। পেশাগতভাবে তিনি একজন নেভাল আর্কিটেকচার। মূল পেশার পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে অনেস্ট দেখভাল করেন তারা।
নান্দনিক সজ্জা
ক্রেতারাও লাভের অংশীদার
জানা যায়, অনেস্টের প্রত্যেকটি পণ্যের ক্রয়মূল্য এবং বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত থাকে। ক্রয়মূল্যের সঙ্গে ২৫ শতাংশ লাভ যুক্ত করে পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয়। আবার লাভের ২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থাৎ মোট লাভের ৬০ শতাংশ সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহক পেয়ে যান। আবার অবশিষ্ট ১০ শতাংশ লাভের ৬০ শতাংশ ব্যয় করা হয় চ্যারিটিতে। পণ্যের অবশিষ্ট লভ্যাংশ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের অপারেশনাল ব্যয় নির্বাহ করা হয়।
ভলান্টিয়াররা জানান, এখানে সমস্যাগ্রস্ত লোকজন বাকিতে পণ্য নিয়ে পরে পরিশোধ করতে পারেন। তাছাড়া গিভিং বউল চাইলে সম্মানের সঙ্গে তা সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ক্যাফেতে কথা হলে এক ভলান্টিয়ার জানান, অনেস্ট ক্যাফেতে লেখাপড়া করে গত বিসিএসে তিনজন লিখিত পরীক্ষায় টিকেছে। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী আসেন অনেস্ট ক্যাফেতে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেস্ট, পে-ইট ফরোয়ার্ড, প্যারেন্টস লাউঞ্জ এবং মার্চ ফরোয়ার্ড মিলে চার লক্ষাধিক মেম্বার ও ফলোয়ার রয়েছে। যাদের বড় অংশই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অনেস্টের সঙ্গে যুক্ত।
অনেস্ট গ্রোসারি ও অন্যান্য পণ্য
সরেজমিনে অনেস্ট সেন্টারে দেখা যায়, সকাল থেকে অনেস্ট ক্যাফের প্রতিটি চেয়ার-টেবিল থাকে পরিপূর্ণ। ক্লাসমেট কিংবা বন্ধুদের নিয়ে পড়াশোনা করছেন শিক্ষার্থীরা। প্যারেন্টস লাউঞ্জেও বসে পড়ছেন অনেকে। পাশাপাশি অবসরে আনন্দ নিয়ে বই পড়ার চমৎকার একটি জায়গা অনেস্ট ক্যাফে। সাইমুল নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা পাশের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। যখন ক্লাস থাকে না, তখন অনেস্টে এসে সহপাঠীরা গ্রুপওয়ার্ক করি। কেউ কাউকে বাধা দেন না। প্রয়োজনে অনেস্টের ভলান্টিয়াররা সহযোগিতা করেন।
রাফিয়া নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অনেস্ট ক্যাফেটি একটি ক্লাসরুমের মতোই। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসের মতো নয়। এখানে শিক্ষার মুগ্ধকর একটি পরিবেশ রয়েছে। এত ছেলেমেয়ে আসে, কিন্তু কোনো কোলাহল নেই। যে যার মতো করে পড়ছে কিংবা শেয়ার করছে। এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে সব সেবাই স্বেচ্ছাশ্রমের, মুগ্ধতা ও মায়া ছড়ানোর।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম