হাতিরঝিলের পানিতে উৎকট গন্ধ, রাজউকের ঢিলেমি
গুলশানের নিকেতনে বাসা লাবিব হাসানের। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সপ্তাহখানেক আগে ছুটিতে দেশে এসেছেন। এর মধ্যে রোববার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে ছোট ভাই হাবিব হাসানকে সঙ্গে নিয়ে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটার এলাকায় ঘুরতে যান। কিন্তু অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে পুলিশ প্লাজার দিকে যেতে সেতুতে উঠতেই নাক চেপে দৌড় দেন দুই ভাই। এক দৌড়ে চলে যান পুলিশ প্লাজার দক্ষিণ পাশে ওয়াটার বাস ঘাটে। সেখানে গিয়ে বড় শ্বাস নেন।
আলাপকালে লাবিব হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝিলের এই ব্রিজ অংশের পানি থেকে পয়োবর্জ্যের দুর্গন্ধ আসছে। পানির রং দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গুলশান, নিকেতন ও বারিধারার বাসাবাড়ির টয়লেটের সংযোগ হাতিরঝিলে দেওয়া রয়েছে। এমন উৎকট গন্ধে বমি আসার উপক্রম হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> হাতিরঝিল ঘিরে ভয়-উদ্বেগ বাড়ছেই
তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার সুবাদে জার্মানিতে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেখানে লেক বা ঝিলের পানি একেবারেই স্বচ্ছ। দেখলে যে কারও পান করতে ইচ্ছে করবে। অথচ হাতিরঝিলের পানিতে পা দেওয়া যায় না।’
লাবিব হাসানের মতো যারাই হাতিরঝিলে বেড়াতে যাচ্ছেন, তাদের সবার অভিযোগ ঝিলের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে চলতি শুষ্ক মৌসুমে দুর্গন্ধ আরও প্রকট হয়েছে। এই পানি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্যও হুমকি। কিন্তু ঝিলের এ দূষণ বন্ধ করতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
হাতিরঝিলের পানি পরিষ্কার রাখতে নিয়মিতই কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। যেসব স্থানে দুর্গন্ধ বেশি সেখানে কেমিক্যাল ছিটানো হয়। তারপরও কোনো এলাকায় বেশি দুর্গন্ধ হলে সেখানে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে।- রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী
রাজধানীর বড় একটি অংশের জলাবদ্ধতা নিরসন, বৃষ্টি-বন্যার পানি ধারণ, রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি নগরের নান্দনিকতা এবং পরিবেশের উন্নয়নের জন্য হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০১৩ সালে। এরপর বৃষ্টির পানি ধারণের পাশাপাশি এলাকাটি মানুষের অবসরে বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন>> অচল ‘রঙিন পানির নৃত্য’, জৌলুস হারাচ্ছে হাতিরঝিল
কিন্তু বছর না ঘুরতেই হাতিরঝিলের পানি দূষিত হওয়া শুরু করে। রোববার (১৪ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিলের পানি বিবর্ণ হয়ে কোথাও কালচে, আবার কোথাও সবুজ রং ধারণ করেছে। পানি থেকে আসছে উৎকট গন্ধ। ঝিলের প্রায় সব অংশ থেকেই দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। এর মধ্যে নিকেতন, পুলিশ প্লাজা, রামপুরা, কারওয়ান বাজার অংশে দূষণের পরিমাণ বেশি মনে হয়েছে।
হাতিরঝিলের এফডিসি এলাকা থেকে ওয়াটার বাসে পুলিশ প্লাজায় যান গুলশান-১ এর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে মঈন উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যানজট এড়াতে হাতিরঝিলে ওয়াটার বাস খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঘাটে পাঁচ মিনিট পরপরই ওয়াটার বাস পাওয়া যায়। কিন্তু ঝিলের দূষিত পানির দুর্গন্ধে সব সময় নাকমুখ চেপে রাখতে হয়। হাতিরঝিলের সৌন্দর্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। আর পানির গন্ধও দিন দিন তীব্র হচ্ছে।’
হাতিরঝিলের পাশে মহানগর এলাকায় থাকেন এম আকাশ। তিনি বলেন, ‘বর্ষার সময় ছাড়া বছরের প্রায় সব ঋতুতেই হাতিরঝিলের পানিতে গন্ধ থাকে। ঝিলটি সবার জন্য যখন উন্মুক্ত করা হয়, তখন অবস্থা এমন ছিল না। পানিও ছিল বেশ স্বচ্ছ।’
রাজউক সূত্র জানায়, হাতিরঝিলের পানি নোংরা হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ আছে। ১৩টি পথ দিয়ে মগবাজার, বেগুনবাড়ি, মধুবাগ, নিকেতন, রামপুরা, বাড্ডা, তেজগাঁও, মহাখালী, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার ও কাঁঠালবাগান এলাকার পানি হাতিরঝিলে আসে। এই পানি অধিকাংশ থাকে পয়োবর্জ্য মিশ্রিত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য হাতিরঝিলে পানি নামার নয়টি পথে বর্জ্য শোধনের যন্ত্রও বসানো হয়েছিল। এরই মধ্যে সবকটি যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
গত বছরের ৪ জানুয়ারি পয়ঃবর্জ্যের সংযোগ ঝিল, সারফেস ড্রেনে, খালে বা লেকে দেওয়া বন্ধ করতে গুলশান, বারিধারা, নিকেতন এলাকায় অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তখন সংস্থাটি জানিয়েছে, গুলশান, বারিধারা, নিকেতন ও বনানী এলাকার ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়ির মধ্যে ২ হাজার ২৬৫টির সুয়ারেজ লাইন লেক কিংবা ড্রেনে সংযোগ দেওয়া। যা মোট বাড়ির ৮৫ শতাংশ। তাই এসব বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগে কলাগাছও ঢুকিয়ে দিয়েছিল সংস্থাটি। এছাড়া বাড়ির মালিকদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বাড়ির নিচে নিজস্ব পদ্ধতিতে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
এক বছরে এ কার্যক্রম কতটা সফল হয়েছে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঝিল, লেক, খালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। আর সারা বছরই মশার উপদ্রব বাড়ছে। তাই গত বছর অভিযানের পাশাপাশি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাড়ি মালিকদের সচেতন করেছি। যাতে তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে। ফলে দূষণের পরিমাণ অনেকাংশে কমছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাতিরঝিলের পানি পরিষ্কার রাখতে নিয়মিতই কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। যেসব স্থানে দুর্গন্ধ বেশি সেখানে কেমিক্যাল ছিটানো হয়। তারপরও কোনো এলাকায় বেশি দুর্গন্ধ হলে সেখানে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম