ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ভূরাজনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশ নিয়ে সরব যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া

ইসমাইল হোসাইন রাসেল | প্রকাশিত: ০৮:০৯ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

ভৌগোলিক অবস্থান, ভূরাজনীতি ও সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ফলে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে ক্ষমতাধর দেশগুলো। তাই ভূরাজনীতির সমীকরণে দেশটির আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরব বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া। নির্বাচনে নজর রাখছে ভারত-চীনসহ অন্যান্য দেশও।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। একদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে রাশিয়া। অন্যদিকে তাদের অভিযোগ অস্বীকার করছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের দুই পরাশক্তির পাল্টাপাল্টি অবস্থানে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ফলে দেশটি আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা ব্যাপক। ফলে বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশে নিজেদের আধিপত্য রাখতে চায়।

বাংলাদেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, এমন মন্তব্য করে ১৫ ডিসেম্বর বিবৃতি দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও মার্কিন দূতাবাস যেভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ভবিষ্যতেও সেভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে এবং দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন সম্মান করা হয়, তা নিশ্চিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত থাকবে

বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনগণের ভোটের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্তোষজনক মনে না হলে ‘আরব বসন্তের’ মতো বাংলাদেশকে আরও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হতে পারে। এমন আশঙ্কার গুরুতর ভিত্তি রয়েছে যে আগামী সপ্তাহগুলোয় ‘পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষে অসুবিধাজনক’ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানান রকমের অবরোধ আরোপ হতে পারে। বাংলাদেশের শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর ওপর আঘাত আসতে পারে। সেই সঙ্গে কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক রায় প্রদানে বাধাদানের তথ্যপ্রমাণহীন অভিযোগ তুলে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন>> জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ সমঝোতার নেপথ্যে

এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছিল রাশিয়া। তবে বরাবরই সেসব অস্বীকার করছে যুক্তরাষ্ট্র।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস হস্তক্ষেপ করছেন বলে যে অভিযোগ করেছে রাশিয়া, তাকে নির্জলা মিথ্যা ও ‘ক্লাসিক্যাল প্রোপাগান্ডা’ বা স্রেফ রটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগবিষয়ক সমন্বয়কারী জন কিরবি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও মার্কিন দূতাবাস যেভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ভবিষ্যতেও সেভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে এবং দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে যেন সম্মান করা হয়, তা নিশ্চিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত থাকবে। অন্য কোনো দেশের নির্বাচনে আমরা কোনো পক্ষ নিই না। বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এ নীতির পরিবর্তন আসবে না। আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করি।

আমি মালয়েশিয়ায় ছিলাম সাড়ে পাঁচ বছর। ওখানে ১৪০-১৫০টা দেশের রাষ্ট্রদূত থাকেন। কিন্তু সেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনোদিন কাউকে নাক গলাতে দেখিনি। ওদের নির্বাচন কীভাবে হয় সেটি দেখার বিষয়ে একবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম। তারা বলেছিল, ‘আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ নেই। আমাদের মতো আমরা দেশ চালাবো। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, রাশিয়ার বক্তব্য গণমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তাতে মনে হয়েছে তারা তাদের চিন্তা এবং তাদের মতামতটা দিয়েছে। এখন অনেকে হয়তো মনে করছে, এ বক্তব্যটা কোনো প্রভাব বিস্তার করবে কি না। এটি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। তারা বলছে ‘আরব উত্থান’ যেভাবে হয়েছিল সেরকম একটা পরিস্থিতির কথা, আমার মনে হয় এরকম কিছু হবে না। এটা আমরা কেউই কামনা করি না। আমরা চাই রাষ্ট্রের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

আরও পড়ুন>> আসন ‘ভাগাভাগি’ নিয়ে দিল্লিতে বিরোধী জোটের বৈঠক

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমেরিকার স্যাংশনস, ভিসানীতিসহ অনেক কিছু শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি এরকমও কিছু হবে না। এখানে একটা অস্পষ্টতা আছে। কে ভিসানীতির আওতায় স্যাংশনস পাবে সেটা স্পষ্ট নয়। এখানে বলা হয়েছে যারা বাধা দেবে। এখন বাধার ব্যাখ্যাটা কী বলছে তার ওপর নির্ভর করবে এটি বাধা নাকি সহযোগিতা। এটা খুবই একটি আপেক্ষিক বিষয়।

কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ না করাই শিষ্টাচার, উল্লেখ করে সাবেক এ সচিব বলেন, শিষ্টাচারের বিষয়টি অনেকটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কে কীভাবে ব্যাপারটি দেখছেন বা ব্যাখ্যা করছেন। একেকজন একেকভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এবং উপলব্ধি করেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে এখন যে কোনো কূটনীতিকের সরকারি দল, বিরোধীদলের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা আছে। এখানে বাধা দেওয়ার অবকাশ নেই। আমাদের কূটনীতিকরা বাইরে গেলে সরকারি দল বা বিরোধীদলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকরা যাতে হস্তক্ষেপ না করেন, সেটিই শিষ্টাচার। একটা ঘটনা ঘটলে সেখানে সুযোগটা সৃষ্টি হয়। তখন কেউ বলছে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে, কেউ বলছেন শিষ্টাচারের মধ্যে।

গত নভেম্বরে ভারতে পঞ্চম যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা আলোচনায় মিলিত হন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি ছাড়াও নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠে আসে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে আমরা জানিয়েছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কেমন হবে, নির্বাচন কেমন হবে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সে দেশের জনগণই তা ঠিক করবে। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সে দেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন>> বিরোধীদের দমনপীড়ন-নির্বাচনের নিয়ম পরিবর্তন করে ফের ক্ষমতায় সিসি

সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাচন দেখতে চায় চীন। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চীন বাইরের কারও হস্তক্ষেপ চায় না। চীন নিজেও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

কে কী বললো না বললো, এটা তাদের মাথাব্যথা। আমার মনে হয় না এ ধরনের (আরব বসন্ত) কোনো সুযোগ আছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। শেখ হাসিনার কারণেই দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত আছে। আমরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করবো।

তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি অবস্থান অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা বলতে পারি। তৃতীয় বা চতুর্থ দেশ এরা তাদের মধ্যে কী আলাপ-আলোচনা করছে, এটা আমাদের জন্য খুবই অনভিপ্রেত বলা যায়। আমরা আলোচনা করতে চাই না। এর আগে চীনকে দেখেছি আলোচনা করতে। আমরা তো কারও কাছে মন্তব্য করতে সলিসিট (অনুরোধ) করিনি।

এদিকে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আরব বসন্তের মতো কাণ্ড ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেন, রাশিয়া কী বলেছে, এটা আমাদের ইস্যু নয়। অনেকে অনেক ধরনের কথা বলবে। কিন্তু আমরা এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা সার্বভৌম, আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করি। কে কী বললো না বললো, এটা তাদের মাথাব্যথা। আমার মনে হয় না এ ধরনের (আরব বসন্ত) কোনো সুযোগ আছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। শেখ হাসিনার কারণেই দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত আছে। আমরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করবো।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এখানে দুটি বিষয় কাজ করে। আমরা ওদের কাছে ধরনা দেই। আমাদের রাজনীতিকরা যেভাবে ওদের কাছে দৌড়ে যায় পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সেটি করে না। সুতরাং এ সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছি আমরা, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা। তারা দেশের মান সম্মান নষ্ট করে। এই রাজনীতিবিদরা এক নম্বরে দায়ী। আজ ওরা সাহস পাচ্ছে শুধু আমাদের জন্য। দুই নম্বর হচ্ছে, বাংলাদেশের একটা পরিচিতি, একটা গুরুত্ব পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। এটা অনেক কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশের বড় রকম একটি ভূমিকা আছে। সেজন্য আমেরিকা বা অন্য শক্তিশালী দেশ চাচ্ছে যে আমরা যেন ওদিকে থাকি। আবার ওদিকে চীন-ভারত চায় আমরা যেন তাদের দিকে থাকি। এই একটা হিসাব-নিকাশ আন্তর্জাতিকভাবে আছে। সেটাও এক্ষেত্রে অনেকটা কাজ করে। তবে মূলত আমাদের জন্য তারা নাক গলাতে সুযোগ পায়, নইলে কোনোদিন সাহস পেতো না।

তিনি আরও বলেন, আমি মালয়েশিয়ায় ছিলাম সাড়ে পাঁচ বছর। ওখানে ১৪০-১৫০টা দেশের রাষ্ট্রদূত থাকেন। কিন্তু সেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনোদিন কাউকে নাক গলাতে দেখিনি। ওদের নির্বাচন কীভাবে হয় সেটি দেখার বিষয়ে একবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম। তারা বলেছিল, ‘আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ নেই। আমাদের মতো আমরা দেশ চালাবো। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’

আইএইচআর/এমএইচআর/জেআইএম