অবরোধে মাঠে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না, অ্যাকশনে যাবে পুলিশ
বিএনপি ও জামায়াতের তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে আজ মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর)। এ অবরোধ কর্মসূচিতে নাশকতার আশঙ্কা করছে গোয়েন্দারা। সেকারণে সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। নাশকতার চেষ্টা কিংবা নাশকতা করা হলে সে যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাইকমান্ড থেকে।
গেলো ২৮ অক্টোবর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, পুলিশ হত্যা, হাসপাতালে আগুন ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা শেষে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচির আড়ালে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি পুলিশের ওপর আবার নির্মম আঘাত এলে যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএনপির এক দফার আন্দোলন ঘিরে সম্প্রতি সহিংসতার বিষয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে পুলিশের আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। মহাসমাবেশ চলাকালে সংঘর্ষে পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় বৈঠকে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, নাশকতা, আগুন দেওয়া, ভাঙচুর ও পুলিশ সদস্য হত্যাসহ নানা অভিযোগে ৩৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১ হাজার ৫৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামি করা হয়েছে আরও অনেককে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য, সহিংসতার ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
ডিএমপি জানিয়েছে, গত ২১ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৯ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতার ঘটনায় ১ হাজার ৭২৭ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এর মধ্যে সমাবেশের দিন ২৮ অক্টোবর ৬৯৬ জনকে এবং ২৯ অক্টোবর ২৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও নাশকতার তথ্য থাকলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে তথ্য জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
ডিআইজি পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, মহাসমাবেশে সহিংসতার পর হরতালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে আগামী দিনের কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
তিনি বলেন, আগের থেকে প্রতিটি দলের মধ্যে সদস্য বাড়িয়ে দিয়ে পুলিশের দায়িত্ব বণ্টন করার পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য টিয়ার শেল, রাবার বুলেট সঙ্গে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, পুলিশের ওপর হামলা ও হত্যাকারীদের আর মাঠে নামতে দেওয়া হবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, যারা আমার আমিরুলকে (নিহত পুলিশ সদস্য) হত্যা করেছে, নির্মমভাবে পুলিশের গায়ের রক্ত ঝরিয়েছে, পুলিশের হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তাদের রাস্তায় আর নামার সুযোগ দেওয়া হবে না। বিশেষ করে বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতা আর রাজপথে থাকতে পারবে না। তারা হত্যা মামলার আসামি, তাদের গ্রেফতার করা পুলিশের নৈতিক দায়িত্ব।
বিএনপির অবরোধে আবার পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে করণীয় কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবর পুলিশ চরম পর্যায়ের ধৈর্য ধরে ছিল। তারপরেও কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে পুলিশ হত্যা করেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় জানতে পেরেছি আগামী তিনদিনের জন্য রেল, সড়ক ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচি আসছে। সেটি সারাদেশে হলেও ঢাকা নগরবাসীর সম্পদ ও জানমালের নিরাপত্তায় ঢাকা মহানগর পুলিশ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আশা করি, আমরা যে নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেবো, সেটির সঙ্গে নগরবাসী ও সব শ্রেণির মানুষ আমাদের সহযোগিতা করবে। যারা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়, আমরা আশা করি তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করবে না। কারণ ধংসাত্মক কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হতে পারে না।
২৮ অক্টোবর সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করতে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সারাদেশের আওয়ামী লীগের উপজেলা, জেলা, পৌর, মহানগরীর সব কমিটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপির মিডিয়া সেল পুলিশ হাসপাতালে অগ্নি সংযোগ, পুলিশ সদস্যদের বেধড়ক মারপিট, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, সমাবেশের আশপাশের এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার সব ধরনের ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এসব ফুটেজ থেকে জড়িতদের ছবি আলাদা করা হয়েছে। ওইসব ছবি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ চলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এই কৌশলকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষে। এ ধরনের কৌশল আগে কখনও গ্রহণ করা হয়নি। হামলাকারীদের ছবি দেখে সারাদেশের সবাই বুঝতে পারবেন কে তার এলাকার। তার নাম ঠিকানা নিয়ে গ্রেফতার তালিকা তৈরি করবে পুলিশ সদর দপ্তর। পরে তা সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এরমধ্যে আইজিপির মিডিয়া সেল থেকে দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে গাজীপুর এলাকার সংখ্যা বেশি। তারা দল বেঁধে পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং রাজারবাগে পুলিশ হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে মাথার ক্যাপ ও গায়ের গেঞ্জি।
অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কেউ যেন কোনো ধরনের নাশকতা ও জানমালের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সারাদেশেই র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত রয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ৩১ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তিনদিনের জন্য দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এতে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষা করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে র্যাব। দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাবের ১৫ ব্যাটালিয়নের তিন শতাধিক টহল দল নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম চলবে। কেউ যদি কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতার পরিকল্পনা করে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাবের স্পেশাল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স রিজার্ভ রাখা হয়েছে। এছাড়া নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে র্যাব সার্বক্ষণিক দেশব্যাপী নিয়োজিত থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীরা নাশকতা ও সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা এ ধরনের নাশকতা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকে সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে র্যাব।
অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে নাশকতা ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। সোমবার (৩০ অক্টোবর) রাত থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় টহল দিচ্ছেন বিজিবি সদস্যরা।
তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের অবরোধকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজিবি মোতায়েন থাকবে।
সাধারণ মানুষের চলাচল বা পণ্য পরিবহনে কোথাও বাধা দেওয়া হলে অথবা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কাজ করবে বিজিবি। বিশেষ করে মহাসড়ক ও রেলপথের নিরাপত্তায় বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে।
টিটি/এসএনআর/জিকেএস