ঢাকা উত্তর সিটি
ওয়ার্ড কার্যালয়ে মিলছে জন্মসনদ, সার্ভারের ধীরগতি নিয়ে মতবিরোধ
>>নতুন নিয়মে নিবন্ধক কাউন্সিলর, সহকারী নিবন্ধক ওয়ার্ড সচিব
>>তিন থেকে সাতদিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন পাচ্ছেন নাগরিকেরা
>>নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে জন্ম ও মৃত্যুসনদ দিচ্ছে আঞ্চলিক কার্যালয়
নাগরিকত্ব প্রমাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিবন্ধনসহ দেশে ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। আবার কেউ মারা গেলে মৃত্যু নিবন্ধনের জন্যও লাগে জন্মসনদ। এটি না থাকলে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা যায় না। সবমিলে জন্মসনদ একজন নাগরিকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল নথি। অথচ এ সনদ পেতে ভোগান্তির শেষ নেই নাগরিকদের। রয়েছে নানা অভিযোগ। তাই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে নাগরিক ভোগান্তি কমাতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
নতুন উদ্যোগের আওতায় সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় (১-৩৬ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত) থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ বিতরণ করছে। ফলে নাগরিকদের কষ্ট করে আর আঞ্চলিক কার্যালয়ে যেতে হচ্ছে না। আর নতুন কার্যক্রমের আওতায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সম্পাদনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিবন্ধক ও ওয়ার্ড সচিব সহকারী নিবন্ধক দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন>> টাকা দিলে আগে মেলে জন্মনিবন্ধন সনদ
তাদের দাবি, জন্মনিবন্ধন সেবা সহজ করার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন নাগরিকরা। তবে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভারে ত্রুটি থাকায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না তারা। একবার সার্ভারে প্রবেশ করতে পারলেও আরেকবার যায় না। এতে করে প্রত্যাশানুযায়ী সেবা দেওয়া যাচ্ছে না, এতে সেবাপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
অন্যদিকে, সার্ভারে কোনো ত্রুটি নেই বলে দাবি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। অনেকে দক্ষতার অভাবে নিবন্ধন কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না।
আরও পড়ুন>> মিরপুরে জনবল সংকটে বন্ধ জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম
জানা গেছে, ডিএনসিসির নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে (৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড) আগের মতোই সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ১৮টি ওয়ার্ডে জনবল ও সরঞ্জাম সংকট রয়েছে। কাউন্সিলর থাকলেও সচিব পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ যেসব সরঞ্জাম দরকার, তা এখনো কেনা হয়নি।
প্রাথমিকভাবে ৩৪টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সচিবদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে আলাদা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সার্ভার ত্রুটির কারণে তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। সার্ভারটি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়কে জানানো হলেও এখনো কোনো সমাধান হয়নি।—মেয়র আতিকুল ইসলাম
জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নাগরিকসেবা সহজ করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কার্যালয়ে জন্ম-নিবন্ধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৩৪টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সচিবদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে আলাদা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সার্ভার ত্রুটির কারণে তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। সার্ভারটি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়কে জানানো হলেও এখনো কোনো সমাধান হয়নি।
আরও পড়ুন>> জন্মনিবন্ধন হারিয়ে গেলে কী করবেন?
৩৬টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সেবা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। কিন্তু এ সনদ নিতে গিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তির শেষ নেই। মাসের পর মাস সার্ভার ত্রুটি, দালালের দৌরাত্ম্য, জনবল সংকট এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ ডিএনসিসির বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় চলতি বছরের শুরুতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিবর্তে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএনসিসি। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে নিবন্ধক ও সদস্যসচিব সহকারী নিবন্ধকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সার্ভারে কোনো ত্রুটি নেই বলে দাবি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। অনেকে দক্ষতার অভাবে নিবন্ধন কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না।
ডিএনসিসির জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম তদারকি করে সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিভাগের সূত্র জানায়, ৪ সেপ্টেম্বর ৩৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সচিবদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পরে তাদের প্রত্যেকের পৃথক ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। এরপর দিন থেকেই তারা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আবেদন গ্রহণ করছেন। কিন্তু সার্ভারের কারণে ঠিকমতো সেবা দিতে পারছেন না।
আরও পড়ুন>> পুরোনো জন্মনিবন্ধন অনলাইন করার নিয়ম
উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে ডিএনসিসির ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আফছার উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হলেও ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না। সারাদিন সার্ভার আসে আর যায়। কোনো কাজ হয় না। বিষয়টি ডিএনসিসি মেয়র রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়কে জানালেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব দেওয়ার আগে সার্ভার প্রায় তিন মাস অচল ছিল। এ তিন মাসে অনেক ফাইল আঞ্চলিক কার্যালয়ে আটকে ছিল। এখন সেগুলো আমাদের দেওয়া হয়েছে। একেক করে সবাইকে সনদ দেওয়া চেষ্টা করছি। সামনে স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় চাপ আরও বাড়বে।
দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) মহাখালীতে ডিএনসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ে যান হামিদা বেগম। সেখানে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। হামিদা বেগম বলেন, মহাখালী আইপিএইচ এলাকায় তার বাসা। দুই বছর আগে ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ থেকে তার বড় ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে প্রায় দেড় মাস লেগেছিল। এর সঙ্গে নানা ধরনের হয়রানির শিকারতো হতে হয়েছেই। এখন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন করতে আসছি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই আবেদন জমা দিয়েছি। তারা বলছেন, সার্ভার ঠিক থাকলে তিন থেকে চারদিনের মধ্যে সনদ দিতে পারবে।
আরও পড়ুন>> জন্মনিবন্ধন ইংরেজি করতে করণীয়
অন্যদিকে, ডিএনসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডে দিনে ১০ থেকে ১২টি জন্মনিবন্ধন আবেদন জমা পড়ে বলে জানান ওয়ার্ড সচিব সামিউল ইসলাম। তিনি বলেন, নাগরিকেরা বাইরে যে কোনো দোকান বা নিজে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করে কাউন্সিলর কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। তারপর তারা নির্দিষ্ট ফি রেখে আবেদন জমা রাখেন। তবে, সকালে সার্ভারে কাজ করা গেলেও দুপুরের পর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত সার্ভারে প্রবেশ করা যায় না। তারপরও আবেদনের তিনদিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করছি। সার্ভারে সমস্যা না থাকলে আরও কম সময়ে দেওয়া যেতো।
তবে নিজেদের সার্ভারে কোনো ত্রুটি নেই বলে দাবি করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। অনেকে দক্ষতার অভাবে নিবন্ধন কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না। তবে, অফিস সময়ে সারাদেশ থেকে একই সঙ্গে হাজার হাজার ইউজার (ব্যবহারকারী) সার্ভারে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। তখন সার্ভারে প্রবেশ করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। এটা ঠিক হয়ে হবে।’
আরও পড়ুন>> প্রবাসীরা জন্মনিবন্ধন করবেন যেভাবে
যদিও গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে জাতীয় জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম রেজিস্ট্রার জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনারা ১০ জনের ফোন নম্বর পেপারে দিয়ে দেন। লিখে দেন, জন্মনিবন্ধনে সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। দেখেন- কত ফোন আসে, কত গালি খান। পাসওয়ার্ড দিয়ে ক্লিক করলে কিছু আসে না। গালি খেতে হয় আমাদের। আমাদেরও সহ্যের সীমা আছে। মনের দুঃখ থেকে কথাগুলো বলছি।’
নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সেবা মিলবে কবে?
২০১৬ সালে ঢাকার বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখানসহ ৮টি ইউনিয়ন পরিষদ বিলুপ্ত করে সরকার। পাশাপাশি এ এলাকাগুলোকে ডিএনসিসি ১৮টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব ওয়ার্ডে ‘ওয়ার্ড সচিব’ পদ সৃজন করা হয়নি। নেই ওয়ার্ড অফিস ও সরঞ্জাম। ফলে ডিএনসিসির এসব ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম চালু হচ্ছে না। কারো জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দরকার হলে আঞ্চলিক অফিসে যেতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ঘরে বসে অনলাইনে যেভাবে করবেন জন্মনিবন্ধন
উত্তরা মডেল টাউন ১১ থেকে ১৪ নম্বর সেক্টর, বাইলজুড়ি (আংশিক) এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫১ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পুরোনো সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলরা জন্মনিবন্ধনের দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু নতুন ওয়ার্ডগুলোতে এ সেবা শুরু হয়নি। এখনো মানুষজনকে যানজট ঠেলে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে হচ্ছে। অথচ ভোটের রাজনীতিতে এ নিয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তিনি বলেন, ডিএনসিসি মেয়র আমাদের জানিয়েছেন, নতুন ওয়ার্ডগুলোতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে। হয়তো নিয়োগ সম্পন্ন হলে এ দায়িত্ব পেতে পারি।
এমএমএ/এমএএইচ/এসএইচএস/জেআইএম