অগোচরে আরাভ খান ইস্যু
ইন্টারপোলের রেড নোটিশেই আটকা ৬২ বাংলাদেশি অপরাধী
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) রেড নোটিশেই আটকে আছেন বাংলাদেশি ৬২ জন অপরাধী। কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তার ছবি। কিন্তু বাংলাদেশি এসব অপরাধী ছবির মতোই যেন স্থির! সবশেষ এ তালিকায় যুক্ত হন দুবাইয়ে বাংলাদেশের আলোচিত সোনা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি তিনি। অনেক বিষয়ের মতো মাস ছয়েক আগে হইচই ফেলে দেওয়া আরাভ ইস্যুও চলে গেছে লোকচক্ষুর অগোচরে।
জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশের প্রচেষ্টায় গত ২৩ মার্চ আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। মাঝে আরাভ খান দুবাই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। ইন্টারপোলের রেড নোটিশ মাথায় নিয়েই দুবাই চষে বেড়াচ্ছেন আরাভ। সেখান থেকেই নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে এত কিছুর পরেও আরাভ ইস্যু এখন হাওয়া।
আরাভকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে চেষ্টা চলছে বলে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও নেই দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা। আদৌ আরাভকে ফেরানো যাবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।
আরও পড়ুন>> আরাভ খানের গ্রেফতার তথ্যে ধোঁয়াশা, দুবাইয়ে সোনার দোকান বন্ধ
আরাভকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও ইস্যুটি চাপা পড়ে যাওয়ায় উঠেছে নানান প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরাভের পেছনে থাকা রাঘববোয়ালরা ইস্যুটি কি ধামাচাপা দিয়ে দিলো? তাহলে আরাভের বিচার কি হচ্ছে না? পুলিশ খুন করেও ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় থাকার ফলে আরাভ কি বেঁচে গেলেন?
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, দুবাই পুলিশ আরাভকে এখনো নজরে রেখেছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর থেকে আরাভ দুবাই ছাড়তে পারেনি। এখনো দুবাই পুলিশ আরাভকে দুবাই ত্যাগ করতে দিচ্ছে না।
পুলিশ সদরদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আরাভ ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই অবস্থান করছেন- সেটি আগে বাতিল করতে হবে। সে বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কান্ট্রি টু কান্ট্রি যোগাযোগ চলছে। যোগাযোগ আছে দুবাইয়ের সঙ্গেও।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আরাভকে দ্রুত ফেরানোর আরেকটি বাধা হচ্ছে দুবাইয়ের আইন। ওই দেশে কোনো অপরাধ না করলে অন্য দেশের অপরাধের জন্য কাউকে সাজা দেওয়া হয় না। এমনকি অন্য দেশ থেকে দুর্নীতি ও পাচারের অর্থ ওই দেশে বিনিয়োগ করা নিয়েও কোনো প্রশ্ন করে না দেশটি। তবে অস্ত্র মামলায় আরাভের ১০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দুবাইয়ে। দ্রুতই জট খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> অবশেষে ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকায় আরাভ খান
এদিকে বাংলাদেশে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে ১৮ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঝুলছে পুলিশ সদরদপ্তরের তালিকায়। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় মোট ৬২ জন অপরাধীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। এ তালিকায় রয়েছেন যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও পুলিশের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর ১৮ জনের নামও। তবে নানা চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ সদরদপ্তরের দাবি, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার ও ওমান থেকে ১৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকার পরও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ নামের এক অপরাধীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্টারপোলের মাধ্যমে কামরুল নামের এক হত্যা মামলার আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
পুলিশ সদরদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হলেই শুধু হবে না, ছবি ও নামের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অবস্থান নিশ্চিত হলেও অপরাধীরা অবস্থান বদলে ফেলেন। আবার অনেকে অন্য দেশের পাসপোর্টে সেই দেশ বা অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের শনাক্ত ও দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের আইনও একটি বাধা।
পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে মাত্র একজনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তিনি হলেন ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি সুমন সিকদার ওরফে মুসা। ২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিদেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। এক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। দাপ্তরিকভাবে পুলিশ সদরদপ্তরকে এনসিবির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর অবস্থান, ছবি ও পরিচয় সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ইন্টারপোলকে অবহিত করলে সহায়তা করে সংস্থাটি। ইন্টারপোলের লাল নোটিশে থাকা কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হলে কিংবা মারা গেলে তার নাম ওই নোটিশ থেকে মুছে ফেলা হয়। পাঁচ বছরে একবার ওই নোটিশে থাকা নামের তথ্য আপডেট করা হয়।
পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় শীর্ষ ১৮ সন্ত্রাসী যারা
এখন পর্যন্ত পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আমিনুর রসুল ওরফে টোকাই সাগর, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আরমান ওরফে সুমন, কামাল পাশা ওরফে পাশা, খন্দকার তারভীর ইসলাম জয়, আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, ইমাম হোসেন, খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসু, সোহেল রানা ওরফে ফ্রিডম সোহেল ও খন্দকার নাঈম আহমেদ টেটন।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ৬২ বাংলাদেশি
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশ অব ওয়ান্টেড পারসন্স তালিকায় বিভিন্ন দেশের মোট ছয় হাজার ৯২৬ জন অপরাধীর নাম ও জাতীয়তা তথা দেশের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি ৬২ অপরাধীর নাম।
আরও পড়ুন>> দুবাই পালানোর আগে আরাভ খান থাকতেন কলকাতার বস্তিতে!
তারা হলেন- রবিউল ইসলাম ওরফে রবিউল (আরাভ খান), জাফর ইকবাল, তানজিরুল স্বপন, মোল্লা নজরুল ইসলাম, মিন্টু মিয়া, ওয়াসিম, খোরশেদ আলম, গিয়াস উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, মিজান মিয়া, চন্দন কুমার রায়, রাতুল আহমেদ বাবু, সিরাজ মোস্তফা ওরফে মো. লালু, হারিস চৌধুরী, জাহিদ হোসেন খোকন, মো. সাঈদ হোসাইন ওরফে হোসেন, সাঈদ মোহাম্মদ হাসান আলী, আজিজুর রহমান, অজয় বিশ্বাস, তরিকুল ইসলাম, হানিফ, আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, মো. সবুজ ফকিদ, মো. মনির ভূঁইয়া, শফিক-উল, আমান উল্লাহ শফিক, আবুল কালাম আজাদ, জাহিদুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন খান, মোহাম্মদ ইকরাম খান ওরফে নাঈম খান, ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, মো. ইউসুফ, আব্দুল আলীম শরীফ, মজনু আহমেদ, নুরুল দিপু, মোহাম্মদ ফজলুল আমিন জাবেদ, এসএইচএমবি নুর চৌধুরী, আব্দুর রশিদ খন্দকার, নাজমুল আনসার, শরফুল হোসেন আহমেদ, শরিফুল হক ডালিম, রউফ উদ্দিন, মোসলিম উদ্দিন খান, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ তাজ উদ্দিন মিয়া, সালাহউদ্দিন মিন্টু, গোলাম ফারুক অভি, শেখ হারুন, সুজিত সুলতান, তৌফিক আলম, জাফর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, জিসান আহমেদ জিসান, আমিনুর রাসুল, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, নবী হোসেন, সুব্রত বাইন ত্রিমতি, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস ও আব্দুল জব্বার।
ফেরানো যায়নি বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ খুনিকেও
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয়জনের এখন পর্যন্ত ফাঁসি হয়েছে। বাকি আরও পাঁচজন। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে, আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছেন সেই তথ্যও নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
মডেল তিন্নি হত্যার প্রধান আসামিও কানাডায়
এক সময়ের আলোচিত মডেল তিন্নি হত্যা মামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুক অভি। আশির দশকের এ ছাত্রনেতার ওপর ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। অভি কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তাকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
আরাভকে ফেরানোর বিষয়ে যা বলছে পুলিশ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবির একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, দুবাই পুলিশ আরাভকে নজরদারিতে রেখেছে। দুবাই ছেড়ে আরাভ অন্য কোনো দেশে যেতে পারছে না। আমরা আশা করছি শিগগির তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, কারও বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ ইস্যু করতে হলে কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা হওয়া, ওয়ারেন্ট ইস্যুসহ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে রেড নোটিশ ইস্যু করা হয়। আরাভ খানের বিষয়েও যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রেড নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে এবং তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সব প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
এছাড়া ইন্টারপোলের বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে যে ৬২ অপরাধীর তালিকা রয়েছে তাদেরও যথাযথ আইন মেনে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
টিটি/এএসএ/এএসএম