‘বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই’
ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ডিস্টিংগুইস ফেলো ও প্রথম নির্বাহী পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন। লিখছেন, গবেষণা করছেন রাজনৈতিক অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।
আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: আসন্ন নির্বাচন ঘিরে ফের রাজনৈতিক সংকট। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও এমন সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: গত পাঁচ দশকের হিসাব ধরে আলোচনা করলে বাংলাদেশের যে অর্জন তা বিশ্বের যে কোনো সম্প্রদায়েরই নজর কাড়বে।
একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ, এরপর নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন। এর মধ্যেও বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হয়ে গেলো সমকক্ষ দেশগুলোকে পেছনে ফেলে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসা, দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে নামিয়ে নিয়ে আসা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল অগ্রগতি তো চোখে পড়ার মতো। এ অর্জন তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ, এরপর নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন। এর মধ্যেও বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হয়ে গেলো সমকক্ষ দেশগুলোকে পেছনে ফেলে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসা, দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে নামিয়ে নিয়ে আসা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল অগ্রগতি তো চোখে পড়ার মতো। এ অর্জন তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে, বাংলাদেশ টেকসই জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। সেই সন্দেহ কাটিয়ে আমরা নিঃসন্দেহে নানা সাফল্যগাঁথা রচনা করে চলছি। সম্প্রতি এ সাফল্য আরও বেগবান হয়েছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ: এই সাফল্যের ক্রেডিট মূলত কাদের দেবেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের যা সাফল্য তা একই সঙ্গে যেমন রাষ্ট্র-সরকারের নীতির প্রতিফলন, তেমনি ব্যক্তিখাতের, সাধারণ মানুষের অবদান রয়েছে। যৌথ সাফল্যে বাংলাদেশ আজ এই জায়গায় বলে মনে করি।
বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা আমাদের জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন ১৯৭০ সালের নির্বাচন স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইভাবে ১৯৯১ সালের নির্বাচন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। ২০০৮ সালের নির্বাচন মূলধারার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে। একইভাবে ২০২৪ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ক্রান্তি উত্তরণের সময় বলে মনে করি।
জাগো নিউজ: কেন এমনটি মনে করছেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের যে অর্জন তা কতটুকু টেকসই হবে তা নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার ওপর। যদি আমরা গণতান্ত্রিক সংকটের উত্তরণ না ঘটাতে পারি, তাহলে উন্নয়নের ধারা পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবো না।
জাগো নিউজ: সার্বিক পরিস্থিতি কী জানান দিচ্ছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে গত পাঁচ দশক পার করেছে। রাজনৈতিক সংকটও ছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা, সামরিক শাসন, নাগরিক আন্দোলনের মধ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো ঘটনা আমাদের দেখতে হয়েছে।
আমরা যে ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি, তা নতুন ঘটনা নয়। আমাদের ইতিহাসে এমন ঘটনা বহু আছে। আমরা অনেক ঘটনাই সফলতার সঙ্গে উত্তরণ করতে পেরেছি। ১৯৯১ সালের ঘটনা তেমনই। রাজনীতিকদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজও তখন ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে নাগরিক শক্তিগুলো এক হয়ে কাজ করলে সমাধান করা সহজ হয়।
আর যদি রাজনীতিবিদরা এমনভাবে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে বিকৃত করার চেষ্টা করে তাহলে ফলাফল ভালো হয় না। ২০০৬ সাল তার প্রমাণ। আমাদের কাছে ভালো সমাধানও আছে আবার খারাপ সমাধানও আছে।
আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। বিদেশিরা কখনো সমাধান দিতে পারে না। বিদেশিরা হয়তো বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যুক্ত হন। কিন্তু শেষ বিচারে বাংলাদেশের মানুষকেই সমাধানের পথ বের করতে হয়। মানুষকে দৃশ্যমানভাবে তার কণ্ঠস্বর প্রকাশ করতে হয়। যদি এই কণ্ঠস্বর প্রকাশ না পায়, তাহলে কোনো সম্ভাবনাই আর কার্যকর করা যায় না।
জাগো নিউজ: ২০০১ সালের পর নাগরিক সমাজ যেভাবে সোচ্চার ছিল, বর্তমানে সেভাবে ভূমিকা রাখছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নাগরিক সমাজ নানাভাবে বিভাজিত এবং সেটা স্বার্থের কারণেই।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি এমন অভিযোগের সঙ্গে প্রথমত একমত হতে পারলাম না। নানা আদর্শের ভিত্তিতে, নানা মতের ভিত্তিতে রাজনীতি বিভাজিত হয়। নাগরিক সমাজও নানা আদর্শের ভিত্তিতে বিভাজিত হতে পারেন। এখানে দোষের কিছু নেই। আপনি যাদের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন, তারা আসলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি না। তারা সরকারপক্ষ থেকে উপঢৌকন নিয়ে উপদল হিসেবে কাজ করেন। তারা রাজনীতিরই উপছায়ায় অবস্থান করেন। তাদের দায়-দায়িত্ব নাগরিক সমাজের ওপর দিতে পারেন না। সত্যিকার নাগরিক প্রতিনিধিরা কারও কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারে না। তবে আমি মনে করি বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের অবস্থা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে জটিল।
আপনি যদি বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ তোলেন, তাহলে আমি বলবো সর্বাপেক্ষা বিরাজনীতিকরণ চলছে এখন। আমলাতন্ত্র দেশ চালাচ্ছে। এটি রাজনীতিকরাই বলছেন। যে দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি দুর্বল থাকে সে দেশে নাগরিক সমাজ কাজ করতে পারে না।
জাগো নিউজ: নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে যে ১/১১ সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা আছে এবং বিরাজনীতিকরণে তারা সোচ্চার ছিলেন। এ অভিযোগ সরকার এবং বিরোধী জোট উভয়ই করে আসছে। আর এ কারণেই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জনআস্থা হারিয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি এ অভিযোগের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একমত না। যে দেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, সে দেশে নাগরিক সমাজ দুর্বল থাকে। মানুষ ভোট দিতে না পারলে নাগরিক সমাজ কার কণ্ঠস্বর নিয়ে এগোবে।
আপনি যদি বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ তোলেন, তাহলে আমি বলবো সর্বাপেক্ষা বিরাজনীতিকরণ চলছে এখন। আমলাতন্ত্র দেশ চালাচ্ছে। এটি রাজনীতিকরাই বলছেন। যে দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি দুর্বল থাকে সে দেশে নাগরিক সমাজ কাজ করতে পারে না।
এএসএস/এএসএ/জিকেএস