২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
প্রধানমন্ত্রী বলার পরও চাকরি হয়নি সবুজের
সম্রাট আকবর সবুজের বয়স তখন ১৭ কিংবা ১৮। আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচিতে মা মাহমুদা মনোয়ারা বেগমের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ‘জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী’ সমাবেশেও ছিলেন মাহমুদা বেগম। সেদিন মায়ের সঙ্গী হয়েছিলেন সবুজও। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যার প্রতি এ ভালোবাসাই যে জীবনে নিয়ে আসবে করুণ পরিণতি তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি মা-ছেলে।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৯তম বার্ষিকীতে সেই হামলার লোমহর্ষক স্মৃতি রোমন্থন করেছেন সম্রাট আকবর সবুজ। জানিয়েছেন তার জীবন-যাপনের দুঃখ গাঁথা।
১৯ বছর আগের একুশে আগস্টের সেই দিনটি কেমন ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মাদারীপুরে ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওইখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে আমাদের একটা মহব্বত-ভালোবাসা। তাই আমার মা তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল স্যার, বাহাউদ্দিন নাছিম মামা এবং অন্য নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে যোগ দিতেন। আমরা মা আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।’
আরও পড়ুন>> স্প্লিন্টারগুলো নড়াচড়া করলে ব্যথায় কুঁকড়ে যাই
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ২১ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ করার প্রস্তুতি নেয়। আমার মা বলেন, মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ করার অনুমতি সরকার দেয়নি। টালবাহানার এক পর্যায়ে গভীর রাতে তারা অনুমতি দেয়। শেষে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।’
‘আমার বয়স তখন ১৭-১৮ বছর। আমিও মায়ের সঙ্গে সমাবেশে যাওয়ার বায়না ধরি। বলি, তুমি সবসময় বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে দেখতে যাও, আমারে নেও না, আমাকে দেখাও না। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে কাছ থেকে দেখবো। আমার নেত্রী তার মা-বাবা, ভাই সবাইকে হারিয়েছেন। এটা আমাকে খুব কষ্ট দিতো।’
সবুজ বলেন, ‘মা আমাকে নিয়ে যান। ওইদিন আওয়ামী লীগের সমাবেশ ঘিরে কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি তখনকার সরকার। বিভিন্ন ভবনের ছাদে পুলিশ থাকে, কিন্তু সেদিন ছিল না। আমি ও আমার মা ছিলাম ট্রাকের সামনে। আমরা বসেছিলাম। নেত্রীর কথা শুনছিলাম। নেত্রী যখন কথা শেষ করলেন, একজন সাংবাদিক বললেন ম্যাডাম আমার তো সংবাদ কাভার হয়নি, আবার বলার অনুরোধ জানান। ওই সময় প্রচণ্ড শব্দ হলো। দেখলাম একটা গ্রেনেড ট্রাকের পাশে লেগে নিচে পড়লো, আরেকটি গ্রেনেড আইভি রহমানের গায়ে পড়লো। এরপর দেখলাম একটার পর একটা গ্রেনেড আসতেই থাকলো। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।’
আরও পড়ুন>> আতঙ্ক কাটলেও রয়ে গেছে ভয়াল জঙ্গিবাদের বীজ
তিনি বলেন, ‘মানুষ চারদিকে দৌড়াচ্ছে। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। রক্ত ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়। রক্তের ছিটা এসে আমার গায়েও লাগলো। হঠাৎ আমার পিঠে কী এসে লাগলো, আমি পড়ে গেলাম। ওই সময় পুলিশ আমাদের উদ্ধার না করে উল্টো টিয়ারশেল, গরম পানি ছোড়ে। আমার যৌনাঙ্গের ভেতর গ্রেনেডের স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। রক্তে ভেসে যায় যৌনাঙ্গ। আমরা পিঠ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি ও আমরা মা যখন পড়ে যাই, এরপর কত মানুষ যে আমাদের মাড়িয়ে চলে গেছে, তার হিসাব নেই। একপর্যায়ে আমার হুঁশ ছিল না। মায়ের একটু হুঁশ ছিল, মা কান্নাকাটি করছিলেন।’
‘মায়ের শরীরে অনেক স্প্লিন্টার, তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। মাকে আমি দেখলে ঠিক থাকতে পারি না, মাও আমাকে দেখলে ঠিক থাকতে পারেন না। মা এখন কেরানীগঞ্জে থাকেন। আমরা ১২ মাসই অসুস্থ থাকি।’
এখন কেমন আছেন- জানতে চাইলে সবুজ বলেন, ‘আমার কোমরে ব্যথা, আমার বয়স ৩৫-৩৬ বছর, কিন্তু লাঠি ছাড়া চলতে পারি না। ভারী কাজ করতে পারি না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। আমি আজ অর্থের জন্য চিকিৎসা করতে পারি না।’
আরও পড়ুন>> মোহাম্মদ হানিফের সংগ্রামী জীবন নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার আবেদন, আমার যেন সুচিকিৎসা হয়। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এখানে জামায়াত-বিএনপির অনেক চাপ। পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা পাওয়া যায় না। আমি প্রতিবাদী কণ্ঠ, তারা আমার ক্ষতি করতে চায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাই না। অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তো আমার অস্তিত্বই থাকবে না।’
‘মিরপুরে আহতদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শুনেছি। আমরা এখনো পাইনি। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রতিও দয়া করবেন। সেখানে থাকলে আমি ও আমার মা নিরাপত্তাটাও পেতাম।’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন>> ২১ আগস্ট ঘিরে বন্ধ থাকবে ঢাকার যেসব সড়ক
সম্রাট আকবর সবুজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে মিনতি, আমাদের নিরাপদ একটা থাকার ব্যবস্থা করেন। আমার চিকিৎসাটা একটু করান। আমাদের দিকে একটু খেয়াল রাখেন।’
তার মাকে সরকারের পক্ষ থেকে ২৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা আছে। সেটা থেকে মা যে টাকা পান তা দিয়ে তার ওষুধের খরচটা হয়ে যায়। আমিও তো আহত হলাম, কিন্তু কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। আমাদের কথাগুলো আসলে নেত্রীর কাছে যায় না। একটি শ্রেণি রয়েছে, তারা চায় না, আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকি।’
আরও পড়ুন>> ‘সেদিন আমাদের চিকিৎসা দিতেও নিষেধ করা হয়েছিল’
সবুজ বলেন, আমি নেত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করেছিলাম। ড. নমিতা হালদারের (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব) মাধ্যমে দেখা করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী বলার পরও আমার চাকরি হয়নি, তিনি বলার পরও আমরা চিকিৎসা হয়নি। বলেন কোন দেশে আমরা থাকি। আমরা আমাদের সবকিছু দিয়ে এ দলের পাশে ছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রস্রাবের রাস্তায় স্প্লিন্টার, অণ্ডকোষে স্প্লিন্টার। কোমরে আঘাত রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে আমি ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতাম। এজন্য আমি এখন পর্যন্ত বিয়ে পর্যন্ত করতে পারিনি। বাড়িঘর কিছুই নেই। মা ও আমার চিকিৎসার জন্য সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছি। আমরা বাবা আমাদের চিন্তায় স্ট্রোক করে ৩-৪ বছর ভুগে মারা গেছে। আমি এখন খুব কষ্টে দিনযাপন করছি। কেউ আমাকে মেরে ফেললে খুশি হতাম। এত যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে চাই না।’
আরএমএম/ইএ/জেআইএম