ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’

ইমাম মাহমুদের কথায় সপরিবারে পাহাড়ে ‘হিজরত’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় | প্রকাশিত: ০৮:০৪ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২৩

ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সপরিবারে ও একাকী নিখোঁজ হওয়ার খবর মিলছিল কয়েক মাস ধরে। বিষয়টি নিয়ে নজর রাখছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এক পর্যায়ে তারা জানতে পারেন ঘর ছাড়া ব্যক্তিদের বিশ্বাস, ইমাম মাহাদীর অগ্রবর্তী হিসেবে ইমাম মাহমুদ অবতীর্ণ হয়েছেন। ইমাম মাহাদীর আগে যে ‘দুর্বল প্রকৃতির’ ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে, তাদের নেতা ইমাম মাহমুদ সেই ব্যক্তি। আসলে এটি ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে জঙ্গি সংগঠন ছাড়া কিছুই নয়।

এক বছর আগে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংগঠনটিকে সম্প্রতি নিষিদ্ধও করেছে সরকার। এরই মধ্যে আরেকটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান মিলেছে। যার নাম ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জিহাদের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হিসেবে ঘর ছেড়ে পার্বত্য এলাকায় যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন>> জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নিষিদ্ধ

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের দাবি, ইমাম মাহমুদের আহ্বানে সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতির জন্য কথিত হিজরতের মাধ্যমে নিজ নিজ গৃহ ত্যাগ করে সপরিবারে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করছে এর সদস্যরা। প্রশিক্ষণ শেষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা করছিল সংগঠনটি।

শনিবার (১২ আগস্ট) মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ‘অপারেশন হিলসাইড’ পরিচালনা করে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ১০ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি।

গ্রেফতারের পর ডিএমপির বোম্ব ডিসপোজাল টিম জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য, ৫০টি ডেটোনেটর, ছুরি, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র, কমান্ডো বুট, পাঞ্চিং ব্যাগ, অন্য প্রশিক্ষণ সামগ্রী, দুই বস্তা উগ্রবাদী বই, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করে।

আরও পড়ুন>> ‘ফাহিম তুমি ফিরে আসো, আর পড়াশোনার জন্য চাপ দেবো না’

সিটিটিসি বলছে, সম্প্রতি যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকদের পরিবারসহ ও একাকী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করে সিটিটিসির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। এদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা এলাকা থেকে ডা. সোহেল তানজীম রানা, যশোর থেকে ঢাকার নটরডেম কলেজ শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুর থেকে এরশাদুজ্জামান শাহিনসহ অনেকের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়।

সিটিটিসির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তারা জানান, চলমান অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে গত ৭ আগস্ট রাজধানীর গাবতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে সপরিবারে হিজরত করতে আসা ছয়জন নারী ও চারজন পুরুষসহ ১০ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের একটি টিম। এসময় তাদের সঙ্গে থাকা আট শিশুকে হেফাজতে নেওয়া হয়। গ্রেফতারদের মধ্যে মেহেরপুর জেলা থেকে হিজরতকারী পাঁচটি পরিবার ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে হিজরতকারী একটি পরিবার ছিল।

আরও পড়ুন>> মৌলভীবাজারে জঙ্গি আস্তানা থেকে ১৩ জন আটক: সিটিটিসি

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঘর ছাড়া সবাই কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে স্থাপিত জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিল। তারা মনে করে ইমাম মাহমুদ, ইমাম মাহাদীর অগ্রবর্তী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা বিশ্বাস করে বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে ইমাম মাহাদীর আগে যে ‘দুর্বল প্রকৃতির’ ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে, তাদের নেতা ইমাম মাহমুদ সেই ব্যক্তি। তারা মনে করে কথিত ইমাম মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেবেন।

‘ইমাম মাহমুদ তাদের বলেন, যারা জিহাদে অংশ নেবেন তারা সবাই পরকালীন পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন ও জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রথম ধাপ হলো গৃহত্যাগ তথা হিজরত। তাই জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দশ্যে কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার জন্য তারা সবাই ঘটনাস্থলে মিলিত হয়েছিল।’

সিটিটিসির ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন জানায়, গত ১২ আগস্ট মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একই গ্রুপের আরও এক সদস্য মো. ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয়। ফরহাদকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ফরহাদ জানান, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে তার বেশকিছু অনুসারী আস্তানা স্থাপন করেছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে ডিএমপির সোয়াট টিম ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট মৌলভীবাজারের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পরবর্তীসময়ে কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অবস্থান চিহ্নিত করে সেখানে ‘অপারেশন হিলসাইড’ পরিচালনা করা হয়। অভিযানে চারজন পুরুষ ও ছয়জন নারীসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় হেফাজতে নেওয়া হয় তাদের সঙ্গে থাকা তিন শিশুকে।

জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানানো হয় ৫০ শতক জমি কিনে

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার টাট্টিউলি গ্রামে ৫০ শতক জমি কিনে প্রশিক্ষণ শিবির তৈরি করে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’। সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়ে সশস্ত্র জিহাদে অংশ নিতে কথিত হিজরতের নামে নিজ নিজ বাসা ছাড়েন ওই শিবির থেকে গ্রেফতার হওয়া ১০ জন। সবাই ওই শিবিরে পৌঁছে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেছিলেন। ইমাম মাহমুদের অনুসারী জামিল ওই জমি কেনেন।

আরও পড়ুন>> ৫০ শতাংশ জমি কিনে বানানো হয়েছিল ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র আস্তানা

সিটিটিসি জানায়, কুলাউড়ার আস্তানাটি দুই মাস আগে করা হয়েছিল। যার নামে ওই জমির দলিল করা হয়, তার নামও পেয়েছে। তবে কত টাকা দিয়ে জমি কেনা হয়েছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের সদস্যদের জিহাদের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল, সবকিছুই ওই আস্তানা থেকে করা হতো।

অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষ করেই বড় হামলার পরিকল্পনা
মৌলভীবাজারে জঙ্গি আস্তানায় অংশ নেওয়া পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেফতার জঙ্গিরা সাংগঠনিক নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাম্প নির্মাণ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তারা সেখানে কমান্ডো ধাঁচে প্রশিক্ষণ নিতে সমবেত হন। অভিযানে প্রশিক্ষণের জন্য আনা কমান্ডো বুট, বিস্ফোরক দ্রব্য ও ডেটোনেটরও জব্দ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অস্ত্র সংগ্রহের পর তারা পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল।

কে এই ইমাম মাহমুদ
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ইমাম মাহমুদ বলে যিনি নিজেকে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন তিনিসহ এ সংগঠনের শীর্ষ সদস্যরা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। গ্রেফতার করা গেলেই সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কার পাওয়া যাবে।

তবে তদন্তের স্বার্থে ইমাম মাহমুদের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি সিটিটিসি প্রধান।

আসাদুজ্জামান আরও বলেন, এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা ঘর ছেড়েছেন তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অনেকেই নজরদারিতে রয়েছে। এখনো বেশ কয়েকজন নিখোঁজ। আবার অনেকেই ঘর ছাড়তে গিয়েও সিটিটিসির নজরদারিতে ঘর ছাড়তে পারেননি।

টিটি/এএসএ/এএসএম