চাইলে ঢাকাকে এখনো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী করা সম্ভব
স্থপতি ইকবাল হাবিব। নগর পরিকল্পনাবিদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক। জন্ম ১৯৬৩ সালে। পড়াশোনা করেছেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যায়। ঢাকার হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেক, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের অন্যতম ডিজাইনার। এছাড়া পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন দীর্ঘকাল।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: বিশ্ব পরিবেশ দিবস ৫ জুন। রাজধানীর উষ্ণতা কমাতে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয় একদিকে, আরেকদিকে গাছ কেটে সাবাড় করা হয়। আসলে কীভাবে বেঁচে আছি আমরা?
ইকবাল হাবিব: জলবায়ু উষ্ণতার এমন মহাবিপর্যয়ের সময়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষ নগরায়িত হবে। এর মধ্যে দেশের মোট জায়গার প্রায় এক শতাংশ জায়গায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ধারণ করে জিডিপির ৩৩ থেকে ৩৪ শতাংশ নির্ধারণ করার নাম রাজধানী ঢাকা।
সুতরাং, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের সবার অতিজরুরি করণীয় ছিল। সবার অন্তর্ভুক্তিতায় যে নগরায়ণ তার ভারসাম্য রক্ষায় একটি সোপান বা রূপ তৈরি করা দরকার। একটি দর্শন তৈরি করা দরকার ছিল। এগুলোর অভাবেই ৫০ বছরেও আমরা পরিকল্পিত নগরায়ণে যেতে পারিনি। এ কারণেই কেউ গাছ কাটে, আবার কেউ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ আবার হিট অফিসার নিয়োগ করার পরেও স্বস্তি পায় না।
জাগো নিউজ: এই অস্বস্তির পরিস্থিতি তৈরি হলো কীভাবে?
ইকবাল হাবিব: ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পুঁজিকেন্দ্রিকতা মিলে রাষ্ট্র টেকসই উন্নয়ন থেকে এক হাজার মাইল দূরে সরে গেছে। এই রাজধানীকে কংক্রিট, ধুলি আর শক্ত পাথরে ঢেকে দিতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সমানতালে কাজ করেছে। পাড়া থেকে মহল্লা, মহল্লা থেকে নগরজুড়ে শুধু ব্যক্তিস্বার্থের কারণে প্রাণ-প্রকৃতিকে আমরা ধ্বংস করছি। ভূমির উচ্চমূল্যের কারণে আমরা ভূমিকে শুধু ঢাকতে শিখেছি। একটি ভারসাম্য নগর তৈরি করতে পারিনি এ কারণেই। আমাদের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। বছরের আট মাস অত্যন্ত সহনশীল তাপমাত্রা থাকে। সেই দেশে তো এত উষ্ণ তাপমাত্রা থাকার কথা নয়। এখন আমরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে চলে গেছি। মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে মহাবিপর্যায়ের দিকে এগোচ্ছি।
জাগো নিউজ: মানুষ নিজের বিপণ্নতা ডেকে এনে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা শিখলো কোথা থেকে?
ইকবাল হাবিব: মানুষ আসলে শেখে তার পরিবার থেকে। একটি নগর পরিকল্পনা মানে আমি আপনাকে সহায়তা করবো, আপনি আমাকে সহায়তা করবেন, যা ইচ্ছা তাই আমি করতে পারি না। কিন্তু যার যা খুশি তাই করছে। কেউ উন্নয়নের নামে সব বায়ুদূষণ করে ফেলছে, কেউ গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। এজন্য ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র সবাইকে দায়ী করতে হবে।
এই শিক্ষা পুঁথিগত শিক্ষা নয়। এটি সামাজিক শিক্ষা, এটি রাষ্ট্রীয় শিক্ষা। গ্রামে আগে সরদার ছিলেন। মুরুব্বি ছিলেন। এখন কাউকে পাবেন না। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা উঠে গেছে। ধনী-দরিদ্র সবাই মিলেই আমরা পরিবেশটা ধ্বংস করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে কেউ আর ভাবি না।
জাগো নিউজ: নিরাশাই ঘিরে রাখছে?
ইকবাল হাবিব: আমাদের নিরাশাবাদের কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আমরা নিরাশাবাদ তৈরি করে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
আপনি রাজশাহী ও রানাপ্লাজার ঘটনা সামনে এনে তুলনা করেন। চার বছর আগে রাজশাহী দ্রুত সময়ে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রেকর্ড করেছিল। নানা কারণেই রাজশাহী অনেকটা পরিষ্কার নগরী। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে কম ঘনবসতি। কিন্তু তারা যে অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব সবুজায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা তো অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। রাজশাহী তো আমাদেরই একটি শহর।
আবার রানাপ্লাজা ধসের পর প্রতিটি পোশাক কারখানা সবুজ কারখানায় রূপ নিচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সবুজ ইন্ডাস্ট্রিজ এখন বাংলাদেশে। তার মানে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে জানি। সমাধানের জন্য আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে জানি।
জাগো নিউজ: এই পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ কী?
ইকবাল হাবিব: জনঅধিকার রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে প্রাধিকার পাচ্ছে না। আমরা চাই রানাপ্লাজার ঘটনা আর না আসুক। কিন্তু হয়তো এমন একটি ঘটনার মধ্য দিয়েই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
জাগো নিউজ: রানাপ্লাজার মতো আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। আমতলি, তাজরীন, চুড়িহাট্টা সবশেষ বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেটে আগুন। কই, ঘুরে দাঁড়ালো না তো মানুষ। তার মানে ঘুরে দাঁড়াতে বিপর্যয়টা আরও ভয়াবহ হয়ে আসতে হবে?
ইকবাল হাবিব: রানাপ্লাজার কারণে আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতকে আমরা সবুজ করে ফেলেছি। কারণ এখানে বায়াররা ছিলেন। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ছিল। আমরা কেন পারছি না? এর কারণ হচ্ছে জনগণকে আমরা উন্নয়ন বা শাসনব্যবস্থার অংশ করতে পারি না। জনগণ তার ভোটাধিকার নিয়েও আর লড়াই করে না। রাষ্ট্র জনগণকে এক ধরনের অবহেলার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের কথা শোনাচ্ছে।
তবে এটাও মনে করতে হবে, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। মানুষ মুখিয়ে আছে তার ভূমিকা রাখতে। সরকার বা রাষ্ট্র জনগণকে সঙ্গে নিতে চাইছে না।
আমি মনে করি জনঅধিকারের বিষয়টি বা ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি যদি নির্বাচনে প্রধান ইস্যু করা যায়, তাহলে ২০৪১ সালে আমরা পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব নগরায়ণ করতে পারবো।
জাগো নিউজ: আপনার এই আহ্বান গুরুত্ব না পেলে কী পরিণতি ভোগ করতে হবে?
ইকবাল হাবিব: আমরা একটি বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরি করছি। নাক, কান, শ্বাস-প্রশ্বাস, ফুসফুস, কিডনি সব তাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চয় চাই না আমার সন্তান বেড়ে উঠুক বিকলাঙ্গতায়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবহেলার শিকার।
জাগো নিউজ: এবছর ধারাবাহিকভাবে ঢাকার বায়ু বেশি দূষণ থেকেছে। এরপরেও রাজধানীতে গাছ কাটা দেখতে হচ্ছে। দায়িত্বটা আসলে নেবে কে?
ইকবাল হাবিব: উন্নয়নের নামে পান্ডামূলক কাজও হচ্ছে। অনেকেই বুদ্ধিভিত্তিক দূরাচার করেন। তারা হয়তো বলছেন, গাছ কেটে নতুন করে ঘাস লাগিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু তারা ভুলে যায় এক লাখ চারা গাছ একটি বড় গাছের সমান নয়। ছায়ায় ঢাকতে না পারলে উত্তাপ কমানো যাবে না। ঘাস তো আর ছায়া দেবে না। অন্যায় বুদ্ধিভিত্তিক পরামর্শ কেউ না কেউ দিচ্ছে। নইলে তো এমন উন্নয়ন দেখতে হতো না।
কিন্তু আমাদের সচেতন হয়ে তাদের এই ভুলটা ধরিয়ে দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, নগর উন্নয়নের কারিগররা যদি জনগণের সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণাবোধ করেন, আগ্রহ না রাখেন, তাহলে তো সমাধান আসবে না। আমি যা ভাবি, তাই করবো এমন গোয়ার্তুমি দিয়ে একটি নগর চলতে পারে না।
জাগো নিউজ: তার মানে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য আপনি রাজনীতিকেই প্রধানত দায়ী করছেন?
ইকবাল হাবিব: অবশ্যই আমি রাজনীতিকে দায়ী করবো। রাজনীতি মানে তো শুধু ক্ষমতা নয়। রাজনীতি মানে জনদায় উপলব্ধি করা। সবার শক্তিগুলো গেঁথে এক জায়গায় নিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু বারবার উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা বলছেন। কিন্তু তার কাজের বিকৃতি প্রতিফলন ঘটাচ্ছে কারা, এটি বের করতে হবে। এই প্রশ্ন তোলা দরকার।
মানে আমরা সত্যিকার অর্থে চাপটা তৈরি করতে পারছি না। ভোটাধিকারের জায়গাটা পোশাকখাতের বায়ারদের মতো শক্ত করতে হবে যেন উপযুক্ত চাপ তৈরি করতে পারি। চাইলে এখনো ঢাকাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: সচেনতার জন্য আপনার কী পরামর্শ?
ইকবাল হাবিব: জনগণের শক্তিকে আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণই রাষ্ট্রের মূল মালিক সেটা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কথা রাজনৈতিক দলগুলোকে শুনতে হবে, এই প্রশ্নে আমরা যেন ভ্রান্তিবিলাসে না থাকি।
তবে আমরা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। পরিবর্তনের আভাসও পাচ্ছি। এ কারণেই আমি হতাশাবাদী না। নতুনদের প্রতিবন্ধিতার দিকে ঠেলে দিয়ে কোনো উন্নয়ন আমরা দেখতে চাই না। জনগণ মেনে নেবে না, এটি শোনার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
জাগো নিউজ: পরিবর্তনের আভাস বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
ইকবাল হাবিব: নগরীতে হঠাৎ কিছু করেই আপনি পার পাবেন না। তরুণরা নেমে যাচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে। আন্দোলন হয়। অন্তত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বলতে শিখছে, ‘মানি না, মানবো না’। এটিই তো পরিবর্তনের বড় আভাস। আমি মনে করছি রাজনীতিতেও এমন গুণগত পরিবর্তন আসবে।
এর কারণ হচ্ছে, মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবর্তন হতেই হবে। অন্যরা পারলে আমরা পারবো না কেন? আমরাও তো অনেক এগিয়েছি। এই এগোনোর মধ্যে সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারলেই সমাধান মিলবে। সংস্কার দরকার। গাছ কেটে ঘাস লাগালে হবে না। গাছ না কাটাই ভালো। কাটলে গাছের পরিবর্তে গাছই লাগাতে হবে। এটি বুঝতে পারার ব্যাপার। জনগণের কথা শোনার জন্য কানটাকে বড় করতে হবে। অল্প কিছু পরিবর্তনে আমরা বড় কিছু পরিবর্তন দেখতে পাবো।
জাগো নিউজ: আপনি হাতিরঝিল প্রকল্পেরও অন্যতম নকশাবিদ। এখান থেকেও শিক্ষা নেওয়ার আছে?
ইকবাল হাবিব: হাতিরঝিলের পরে আরও অনেক প্রকল্প হয়েছে। জেগে ওঠার জন্য হাতিরঝিল একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। এ কারণেই বলছি, পরিবর্তনের আবহ তৈরি হয়েছে। আমরা আরও প্রকল্পের কথা শুনতে পাচ্ছি। সবাই মিলে হাত বাড়ালে পরিবর্তন হবেই।
জাগো নিউজ: ঢাকার নদ-নদী বাঁচানোর তাগিদ নিয়ে কী বলবেন?
ইকবাল হাবিব: আমি মনে করি, টেকসই উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবারের নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত। অন্তত নগরগুলো বাঁচানোর জন্য এমনটি হওয়া জরুরি। আর এটি হলে নদ-নদী সবই রক্ষা পাবে। নগর বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম