‘জাতিসংঘের কনফারেন্সের’ আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সে মানবপাচার
মানবাধিকার কর্মকর্তা সেজে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে মানবপাচারে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। চক্রের মূলহোতা মহিউদ্দিন জুয়েল ও উজ্জল হোসাইন মুরাদ ‘প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ নামে কথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে এ অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন।
চক্রের সদস্যরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার কথা বলে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ভুয়া তথ্যযুক্ত ই-মেইল পাঠিয়ে আমন্ত্রণপত্র আনতেন। তা দেখিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন বড় অংকের টাকা। এভাবে চক্রটি জাতিসংঘ ও মার্কিন দূতাবাসকে ধোঁকা দিয়ে মানবপাচার করে আসছিল। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত।
আরও পড়ুন: ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ৬২ বাংলাদেশি
অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি এ প্রতারক চক্রের। তাদের জালিয়াতি একসময় নজরে আসে মার্কিন দূতাবাসের। পরে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সহকারী রিজিওনাল সিকিউরিটি অফিসার মিকাইল লি গত ২১ মে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। সে মামলার তদন্ত করে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
জালিয়াতির সত্যতা পেয়ে গত রোববার (২১ মে) ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- মহিউদ্দিন জুয়েল, মো. উজ্জ্বল হোসাইন ওরফে মুরাদ, মো. এনামুল হাসান, শাহাদাদ ও হাদিদুল মুবিন।
তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন জুয়েল এলএলবি ও বিএসএস পর্যন্ত পড়াশোনা করে প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ভুয়া চেয়ারম্যান ও উজ্জ্বল মাস্টার্স শেষ করে নির্বাহী পরিচালক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা এবং মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এনামুল এইচএসসি, শাহাদাদ বিবিএস ও হাদিদুল মাস্টার্স শেষ করে এখনো বেকার।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, দুটি ভিজিটিং কার্ড, তিনটি এনওসি ও পাঁচটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করছে
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রের মূলহোতা মহিউদ্দিন জুয়েল ও উজ্জ্বল হোসাইন একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের হোতা। তারা প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন নামের কথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ২০১৯ সাল থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে মানবপাচার করে আসছিল।
প্রতিষ্ঠানটিতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও সমস্যা নিষ্পত্তির অভিযোগ নিয়ে আসে। কিন্তু তারা দুজন অভিযোগকারীর সঙ্গে কৌশলে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে তাদের ইউরোপ-আমেরিকা পাঠানোর প্রলোভন দেখায়। এতে কেউ রাজি হলে তার সঙ্গে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার একটি চুক্তি করে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের বিভিন্ন কনফারেন্সসহ জাতিসংঘের অন্যান্য কনফারেন্সের বিজ্ঞপ্তির খোঁজখবর রাখেন।
এজন্য তারা বেশ কিছু ডকুমেন্টও তৈরি করেন। পাশাপাশি জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ই-মেইলে রেজিস্ট্রেশন করেন। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আমন্ত্রণপত্র চেয়ে ই-মেইল করেন।
আরও পড়ুন: পাচারের পর দুবাইয়ের ড্যান্সবারে বাধ্য করা হতো অনৈতিক কাজে
পরবর্তীসময়ে জাতিসংঘ থেকে ফিরতি ই-মেইল দিলে আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে আরও কিছু কাগজ সংযুক্ত করে মার্কিন দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করে। দূতাবাস প্রার্থীদের সাক্ষাৎ ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে ভিসা দেয়। ভিসা পাওয়ার পর ওই ব্যক্তিরা মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সেখানে অবস্থান করে।
এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার আরও বলেন, গত ১৭ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আদিবাসী ইস্যু প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য নামসর্বস্ব ওই প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে এনামুল হাসান ও হাদিদুল মবিন এবং কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে শাহাদাদ আমন্ত্রণপত্র নেয়। পরে তারা আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে আরও কিছু ভুয়া কাগজপত্র সংযুক্ত করে ঢাকায় দূতাবাসে আবেদন জমা দেয়। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে মার্কিন দূতাবাসের কাছে তাদের জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, এর আগেও আমরা মানবপাচারকারী চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছি। প্রতারকদের এ ধরনের কাজের জন্য বিশ্বে বিভিন্ন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যারা প্রকৃতপক্ষে ভিসার আবেদন করেন তারা নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: টিকটকে পারদর্শী-সুন্দরীদের টার্গেট করে দুবাই পাচার
তিনি বলেন, গ্রেফতার মহিউদ্দিন জুয়েল ও উজ্জ্বল হোসাইন প্রতারণার অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করেছে, নাকি বিদেশে পাচার করেছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
ভিসাপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে ডিসি তারেক বিন রশিদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাসহ যে কোনো দেশের ভিসার জন্য সঠিক ও নির্ভুল তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। মিথ্যা তথ্য দিলে সেটি গুরুতর অযোগ্যতা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় আনা হবে।
টিটি/এমকেআর/জেআইএম