শিক্ষকদের রাজনীতি নয়, শিক্ষকনীতির মধ্যে থাকা উচিত
বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তার স্থান। সেখানে রাজনীতি থাকবেই। থাকবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মুক্তচিন্তা চর্চার সংগঠনও। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কিছুই বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। যেখানে ছাত্র থাকবে, সেখানে ছাত্র রাজনীতি থাকেব, তবে রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি থাকবে না। সবার চিন্তা চেতনা এক নয়, একেক জনের চিন্তা একেক রকম থাকবে। তবে ছাত্র সবাই সমান। শিক্ষকদের কাছেও তাদের পরিচয় ছাত্র। কে ছাত্রলীগ আর কে ছাত্র শিবির সেটা বড় কথা নয়। ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি করা যাবে না। অপরাজনীতি বন্ধে শুধু সরকার নয়, আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।’
কথাগুলো বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ভাষাসৈনিক ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর। সুদীর্ঘ ৫৪ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতাজীবন শেষে এখন সিলেট নগরের ফাজিলচিশত এর বাসায় অবসর জীবন পার করছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকটা অসুস্থ্যও তিনি। সম্প্রতি জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপচারিতার শুরুতে তিনি এ কথাগুলো বলেন। আলাপচারিতায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-রাজনীতি ভাষা আন্দোলনসহ সমাজের নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছিলেন। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য পদ থেকে ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ৫৪ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানেন তিনি।
১৯৫৬ সাল ১ জুলাই ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী রামেন্দ্র কলেজ ফরিদপুরে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে দুই মাস ২০ দিন পর রাজশাহী কলেজ পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে নব প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ অধ্যাপনা এবং ১৯৯৪ সালে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ডীন অব স্টাডিজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাজ্যের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর চল্লিশোর্ধ প্রবন্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার সবচেয়ে সফল গবেষণা হিউম্যান ইনসুলিন ড্রাগের গঠন ও ক্রিয়া ডায়বেটিক চিকিৎসায় বিশেষ অবদান রাখছে।
তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলার, কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ ফেলো, সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো, যুক্তরাজ্য লুভা বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়াম ও ফেলো বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটিতে কর্মরত ছিলেন।
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়ী গ্রামে ১ জানুয়ারি ১৯৩১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি মোছাম্মত খালেদা খাতুনকে বিবাহ করেন। তার তিন মেয়ে নাছেহা চৌধুরী, নাজিয়া চৌধুরী ও নাইমা চৌধুরী সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।
মেজ মেয়ে ড. নাজিয়া চৌধুরী শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি পদার্থ বিদ্যায় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেলসহ স্মাতক ও স্মাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
আলাপচারিতায় শিক্ষকদের রাজনীতি প্রসঙ্গে ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, একজন শিক্ষকতো শিক্ষকই। শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না। শিক্ষকদের কোনো রাজনীতি নেই। কেবল শিক্ষকনীতির মধ্যে থাকা উচিত। শিক্ষকরা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। শিক্ষাকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো যাবে না। শিক্ষকদের দূরাবস্থার জন্য রাজনীতিই দায়ী।
ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা উচিত নয়। আমি নিজেই ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। তবে আমাদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি ছিল না। আমাদের রাজনীতি ছিল ছাত্রদের কল্যাণে।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি নির্বাচন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা হওয়া উচিত নয়। তবে পৃথিবীর সকল রাজনীতি দু’টি ধারায় বিভক্ত ডান আর বাম। ছাত্রদের মধ্যে এই দু’টি ধারা থাকতে পারে। তাদের চিন্তা ভিন্ন হবে। তবে যেমন ডাকসু নির্বাচন, ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে হওয়া উচিত বলে মত দেন এই বরেণ্য গবেষক।
একজন সফল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন নিয়ে কিছু বলবেন?
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, প্রত্যেকে একটা লক্ষ্য নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন এবং শেষ করেন। মুহিত (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। সে বলতো তুই তো জন্মের আগ থেকেই শিক্ষক আর আমি বলবো আজীবন একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষক যখন হালাল পথে শিক্ষকতা করেন এবং ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখনই তাকে সফল বলা যাবে।
আমার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা অধ্যাপক আবু সায়ীদ, আব্দুর রাজ্জাক এমপি-মন্ত্রী হয়েছে। আরো অনেকেই সচিব, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকসহ বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থীই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সততার সঙ্গে যারা শিক্ষকতা করেন তারা সব সময়ই সফল। তাদের বলতে হয়না ভালো করে খাতা দেখবেন। খাতায় মার্কসিটে স্বজনপ্রীতি করবেন না। এসব যে শিক্ষককে বলতে হয় না তিনিই সফল শিক্ষক।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যে স্বপ্ন নিয়ে আপনারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে পথে আছে কী?
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, শেখ শহীদুল ইসলাম না হলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হতো না। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা অনেকেই চায়নি। ১৯৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গায়েব হয়ে যায়। তখনকার শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলামের বিশেষ সহযোগিতার ফলে এ দফা সফল হই। আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করেছিলাম, সে পথেই আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
তবে মাঝে কয়েক বছর বেশ ঝড়ঝাপ্টা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে গেছে। এখন যোগ্যতাসম্পন্ন কিছু শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। মাত্র ৯০ জনের ব্যাচ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখন বেশ কয়েক হাজার দেশী-বিদেশী বিদেশী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু?
ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, কোনো পার্থক্য নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড আসে সরকার থেকে আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড আসে ব্যক্তি মালিকানার কাছ থেকে, এটুকুই পার্থক্য। তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা আছেন, তাদের উদ্যোগ মহৎ হতে হবে। বাণিজ্যিক হলে হবে না।
বিশ্বের নামকরা হাভার্ড ইউনিভার্সিটি ও ক্যামব্রিজ ইউনির্ভার্সিটি প্রাইভেট। এছাড়া আরো অনেক নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোর চেয়ে অনেক ভালো মানের।
দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে কোনো স্মরণীয় স্মৃতি আছে কী?
জবাবে ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ভাষা আন্দোলনকে জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি বলে জানান। তিনি স্মৃতি হাতড়িয়ে ভাষা আন্দোলনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেন।
জনাব চৌধুরী বলেন, ১৯৫১-৫২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যা বিভাগের অনার্সের ছাত্র ছিলাম। আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিল আবুল মাল আব্দুল মুহিত (বর্তমান অর্থমন্ত্রী)। আমরা একে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলে থাকতাম। সেখান থেকে আমার পদার্থ বিদ্যার বিভাগ কাছাকাছি ছিল। আমাদের সিনিয়র ছিলেন ভাষাসৈনিক আব্দুুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখরা।
১৯৫২’র ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনে উত্তাল। সে আন্দোলনে আমি, আমার বড় ভাই বদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মালিক (বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ও জাতীয় অধ্যাপক) আবুল মাল আব্দুল মুহিত (অর্থমন্ত্রী) ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেই। তিনি বলেন, তবে মুহিত ছাত্রজীবনে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে থাকতো। কিন্ত ভাষা আন্দোলনে মুহিত সক্রিয় ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে প্রতিদিন মিছিল-শ্লোগান-বক্তৃতা হতে থাকে। যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের শাসকরা স্বীকার করে নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একটি বিরাট মিছিল বের করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অফিস সংলগ্ন তৎকালীন প্রাদেশিক সংসদ ভবনে সংসদ অধিবেশন চলাকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে, স্মারকলিপি প্রদান করা হবে এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু সরকার ওই তারিখে ১৪৪ ধারা জারি করলো। আমরা রেজিষ্ট্রার অফিস থেকে পূর্ব নির্ধারিত মিছিল বের না করে কলাভবনের সামনে থেকে ১৫/২০ জনের এক একটি দল করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গেট দিয়ে বের হয়ে সংসদ অভিমুখে রওয়ানা হব বলে ঠিক করা হলো।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে দুটো ছাত্রীদের দল রওনা হলো। তারপর বাইসাইকেলে একটা দল হেটে যাত্রা করলো। এরপরে ছাত্রদের একটি দল রওয়ানা হলো। কিন্তু কাউকে সংসদ ভবনে নিকটে যেতে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানি পুলিশের লাঠি চার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। ছাত্রদের একটি দলে আমি, সালাম, জব্বার, রফিক ছিলাম। পুলিশের গুলিতে সালাম ও রফিক আমার চোখের সামনেই রক্তে লাল হয়ে গেলো। প্রথমই আমি তাদের লাশ দেখলাম। এই স্মৃতি আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। বার বার তাদের কথা মনে পড়ে। সেদিন আমি মারা পড়ার কথা। কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে যাই।
৫২’-এর এ ঘটনার পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ লাঠি চার্জ করে হল থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেবে বলে এক ভাষা সৈনিক জানান। পরে আমরা যে যেভাবে পারি বাড়ির পথ ধরি। পায়ে হেটে ঢাবি থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে আসতে হলো। ট্রেনে করে সিলেটে আসার পথে চলে আমাদের বেগ ও দেহ তল্লাশী।
তবে সিলেট নেমে ঠিক উল্টোটা দেখলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়ায় আমাদের অভ্যর্থনা জানানো জন্য সিলেটের কয়েকজন বন্ধু রেলস্টেশনে যান। কিন্তু পুলিশ লাঠি চার্জ করে তাদেরকে বিতাড়িত করে দেয়। এর কিছুদিন পর পাকিস্তান শাসকরা আন্দোলনের মুখে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দেয়।
ছামির মাহমুদ/এফএ/আরআইপি