ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ডিএনসিসি-ডিএসসিসি

কাঁচাবাজারে অব্যস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণহীন গরুর মাংসের দাম

মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ০৭:০০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২৩

#করোনার আগে রমজানে গরুর মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দিতো সিটি করপোরেশন।
#১১ কাঁচাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রদর্শনে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন ডিএনসিসির
#ডিএসসিসির অধিকাংশ কাঁচাবাজারে নেই মূল্যতালিকা।

বেসরকারি চাকরিজীবী হাবিবুর রহমান। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) সকালে সেগুনবাগিচায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র থেকে গরুর মাংস কেনেন ৬৪০ টাকা কেজি দরে। একই সময় সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার থেকে ৮শ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস কেনেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম। এ কাঁচাবাজারের পাশেই সুপারশপ স্বপ্ন। এখানে আবার গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজিতে।

ঢাকা শহরে রোজার মাসেও গরুর মাংস বিক্রিতে চলছে এমন অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা। ভোক্তাদের অভিযোগ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তদারকির অভাবে গরুর মাংসের বাজারে এমন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাংস ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে দাম রাখছেন। বিশেষ করে রমজানে মাংসের চাহিদা বাড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য করণীয় নির্ধারণে কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।

আরও পড়ুন>>‘গরুর মাংস নিতে এসে ৫০০ টাকায় দুই কেজি ব্রয়লার কিনেছি’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেসব কাঁচাবাজার রয়েছে, সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকার চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। বাজার পর্যবেক্ষণে সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তাদের ১১টি কাঁচাবাজারে কৃষিপণ্যের পাইকারি ও প্রস্তাবিত যৌক্তিক খুচরা মূল্য তালিকা সম্বলিত ডিজিটাল এলইডি বোর্ড টাঙিয়েছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় এ ধরনের কোনো কার্যক্রমই দেখা যায়নি।

গরুর মাংসের দামে ভিন্নতা
ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, ঢাকা শহরে এখন দেড় হাজার মাংসের দোকান রয়েছে। এসব দোকানের মালিকেরা হাট থেকে পশু কিনে নিজ দোকানের সামনেই জবাই দেন। পরে গরুর দামের ওপর নির্ভর করে মাংসের মূল্য নির্ধারণ করেন। তবে এখন অঘোষিতভাবে সব দোকানে ৮শ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন নীরব। ফলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির কিছু করার থাকছে না। চলতি বছর রোজায় মাংসের দাম কেজিতে গড়ে বেড়েছে ৫০ টাকা।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ২০২০ সালে করোনার আগে প্রতি বছর রমজানে মাংস ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠক আহ্বান করতো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বৈঠকে রমজানে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হতো। সবশেষ ২০১৯ সালে সবার সম্মতিতে গরুর মাংসের দাম কেজি ৫২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত মাংসের দাম নিয়ে আর কোনো বৈঠক করেনি ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি। ফলে নগরে মাংস ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে।

আরও পড়ুন>>‘ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো শিখছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে’

পাইকারি গরুর মাংস বিক্রির সবচেয়ে বড় মার্কেট পুরান ঢাকার কাপ্তানবাজার। এই বাজারে আবার বেশ কিছু খুচরা দোকানও রয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) সরেজমিনে দেখা যায়, মামুন মাংস বিতানে ৮শ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। দরদাম করে কেউ কেউ মাংস কিনছেন। অনেকে দাম জেনে মাংস না কিনে ফিরে যাচ্ছেন।

মাংসের দাম এত বেশির কারণ জানতে চাইলে দোকানি মামুন বলেন, মাংস ব্যবসায়ীরা যদি সরাসরি খামার বা কৃষকের কাছ থেকে গরু কিনে মাংস বিক্রি করতে পারতেন তাহলে আরও কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হতো। এখন একজন দোকানিকে ঢাকার একমাত্র পশুরহাট গাবতলী থেকে গরু কিনতে হচ্ছে। এখানে বেশি দরদামও করার সুযোগ নেই। উল্টো গরুর হাসিল বেশি দিতে হচ্ছে। গরু নিয়ে ফেরার সময় পথে বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশের কিছু সদস্যকে চাঁদা দিতে হয়। এই ক্ষতি পোষাতে বেশি দামে মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে।

হাতিরপুল কাঁচাবাজারে কয়েক ধরনের সবজি, মাছ কিনে মাংসের দোকানের সামনে যান কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা মহসিন। কিন্তু মাংসের দাম শুনে মন মলিন করে ফিরে যান। আলাপকালে মহসিন বলেন, গত কোরবানি ঈদ এবং পরবর্তীসময়ে কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে বাজার থেকে মাংস কেনার সাধ্য হয়নি। এখন রমজান মাস। তাই ভাবছিলাম মাংস কিনবো। কিন্তু মাংসের যে দাম, তা কেনা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন>>মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ নিম্নবিত্ত, মাছ ৮৮

রমজানে সিটি করপোরেশন কেন মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয় না, এমন প্রশ্নের জবাবে রাজস্ব কর্মকর্তা (বাজার ও বিবিধ) মিয়া মো. জুনায়েদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, আগে প্রতি বছর রমজানে মাংসের দাম নির্ধারণে একটা প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এমন কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে মাংসের দাম অনেক বেড়েছে। প্রায় একই কথা বলেছেন ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আ ন ম তরিকুল ইসলাম।

ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আগে প্রতি বছর রমজানে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিতো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। মাংসের দাম দিন দিন বাড়লেও কেন বাড়ছে তার কোনো খোঁজ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, গরুর মাংসের দাম বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গরুর হাট এবং মহাসড়কে গরুর গাড়িতে চাঁদাবাজি অন্যতম। এ দুটি কারণে কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়া গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় মাংসের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যথায় এখন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যে দামে গরুর মাংস বিক্রি করছে, একই দামে ব্যবসায়ীরা মাংস বিক্রির সক্ষমতা রাখতো।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ডিএনসিসি, গুরুত্ব কম ডিএসসিসির

রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার নির্ধারিত দাম জনসাধারণের অবগতির জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি তাদের মালিকানাধীন কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, মহাখালী কাঁচাবাজার, মিরপুর-১ এর শাহআলী কাঁচাবাজারসহ ১১টি মার্কেটে মূল্যতালিকাসহ বড় সাইজের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করেছে। এ বোর্ডে প্রতিদিন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত পণ্যের দাম টাঙানো হচ্ছে। একইভাবে প্রতিটি দোকানে যাতে মূল্যতালিকা থাকে, সেটি নজরদারি করছে ডিএনসিসি। কিন্তু তারপরও কাঁচাবাজারগুলোতে সব পণ্যে পাঁচ থেকে ১০ টাকা করে কেজিতে বেশি বিক্রি করতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন>>সুলভমূল্যের দুধ-ডিম-মাংসের চাহিদা বাড়ছে

সরেজমিনে দেখা যায়, মহাখালী কাঁচাবাজারের প্রবেশপথে বড় একটি ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড। সেখানে আজকের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত মূল্যতালিকা রয়েছে। এর মধ্যে দেশি পেঁয়াজ পাইকারি দাম দেওয়া আছে ২৫ থেকে ৩১ টাকা। আর খুচরা মূল্য দেওয়া আছে ২৮ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু এ বাজারের মেসার্স নুসরাত এন্টারপ্রাইজের মূল্যতালিকায় পেঁয়াজের পাইকারি দাম দেওয়া আছে ৩৩ টাকা, আর খুচরা মূল্য ৩৮ টাকা। একইভাবে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে দেশি মসুর ডাল পাইকারিতে ১২০ থেকে ১২২ টাকা এবং খুচরায় ১৩০ থেকে ১৩২ টাকা নির্ধারণ করা আছে। অথচ বাজারে পাইকারি ১৩০ এবং খুচরায় ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে অন্য পণ্যের দামে তারতম্য দেখা গেছে।

জানতে চাইলে জামান এন্টারপ্রাইজের মালিক জামান হোসেন বলেন, সরকার যে মূল্যতালিকা তৈরি করে দেয়, হুবহু সেভাবে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ, পাইকারি মালামাল কেনার ওপর খুচরা বিক্রি নির্ভর করে। এজন্য অনেক সময় দুই-চার টাকা কম বা বেশিতে বিক্রি করতে হয়।

গত ২৩ মাস রমজান মাসে বাজারে সরকার নির্ধারিত দ্রব্যমূল্য তদারকি করতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিসহ কাউন্সিলরদের বাজার মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেন ডিএনসিসি সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক। তার এমন নির্দেশনায় বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এই কমিটির চেয়ারম্যান ও ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, রমজানের শুরু থেকে আমরা প্রতিদিনই ডিএনসিসির কাঁচাবাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। কোথাও কোনো অসঙ্গতি পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাজটি সহজ করতে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও কাজ করছেন। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশিতে পণ্য বিক্রির সুযোগ নেই। আমাদের ডিজিটাল বোর্ডগুলোতে প্রতিদিন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্যতালিকা প্রকাশ করছি।

গত ২৩ মার্চ মহাখালী কাঁচাবাজার পরিদর্শন এবং মূল্যতালিকা প্রদর্শনের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডের উদ্বোধন করেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এদিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত নির্ধারিত মূল্যতালিকার চেয়ে বেশি দাম নিলে দোকান বন্ধ করে দেবো। কেউ ছাড় পাবেন না।’

জানতে চাইলে আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএনসিসির কাঁচাবাজারে বেশি দাম নিলে যে কোনো ক্রেতা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবেন। ডিএনসিসির হটলাইন (১৬১০৬) নম্বরেও অভিযোগ করা যাবে। ডিসপ্লে বোর্ডে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এবং বাজার কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মোবাইল নম্বরও দেওয়া আছে। অনিয়মের বিষয়গুলো তাদের ফোন করেও জানানো যাবে।



দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উত্তর সিটিতে এমন কার্যক্রম চলমান থাকলেও দক্ষিণে তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। তাদের ১৩টি কাঁচাবাজারের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে মূল্যতালিকা দেখা যায়নি। এছাড়া অধিকাংশ দোকানেও মূল্যতালিকা ছিল না। যে যার মতো করে পণ্য বিক্রি করছেন।

নিউ মার্কেট সংলগ্ন ডিএসসিসির বনলতা কাঁচাবাজার। এই বাজারের মেসার্স ইকবাল এন্টারপ্রাইজের মালিক ইকবাল জানান, পণ্যের মূল্যতালিকা না থাকলেও তারা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকা দেখেন। সে অনুযায়ী পণ্য বিক্রি করেন। তবে ক্রেতা মকবুলের অভিযোগ, দোকানিরা যে যেভাবে পারছে, ক্রেতাদের পকেট কাটছে। এখানে নিয়ম-নীতির কোনো বালাই নেই।

ডিএসসিসির কাঁচাবাজারগুলোতে কেন মূল্যতালিকা নেই, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক। তবে রাজস্ব কর্মকর্তা (বাজার ও বিবিধ) মিয়া মো. জুনায়েদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, তারা নিয়মিতই বাজার মনিটরিং করছেন। কৃষি বিপণন তালিকা থেকে পণ্যের দাম খুব বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

এমএমএ/এএসএ/এএসএম