যৌন নির্যাতন-সহিংসতা
৯৯৯ এ প্রতিদিন আসছে অর্ধশতাধিক কল
গাজীপুর মেট্রোপলিটনের পূবাইল থানার কলেজগেট এলাকার ১৯ বছর বয়সী এক তরুণী কয়েক মাস ধরে তার বাবা কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে আসছিলেন। লজ্জা ও ভয়ে কাউকে বিষয়টি বলতে পারছিলেন না তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ অভিযোগ করেন ওই তরুণী। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাবা আবদুল হাকিমকে (৪০) গ্রেফতার করে পুলিশ।
শুধু গাজীপুরের ওই তরুণীই নন, অনেকেই এভাবে পারিবারিক নির্যাতন-সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক কলহ, শিশু নির্যাতন ও আত্মহত্যার প্রবণতা দেশে দিন দিন বাড়ছে। এর প্রমাণ মিলছে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর ফোন কলের পরিসংখ্যান থেকে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং পারিবারিক সহিংসতার কারণে ২০২২ সালে ৯৯৯-এ ফোন করেন ৩৭ হাজার ৩৪০ জন ভুক্তভোগী। প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চপর্যায় থেকেও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফোন করছেন ৯৯৯ নম্বরে।
৯৯৯ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে ৯৯৯-এ কল করা ভুক্তভোগীর সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩০৩ জন। ২০২০ সালে ছিল ১৪ হাজার ৪১ জন। ২০১৯ সালে ছিল ৬ হাজার ১৫১ জন।
গত চার বছরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত কারণে ৯৯৯ নম্বরে মোট ফোন করে সেবা নেন ৮০ হাজার ৮৩৫ জন। সে হিসাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত চার বছরে প্রতিদিন কল করেছেন ৫৫ জনের বেশি মানুষ।
আরও পড়ুন>> প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লিতে তরুণী, ৯৯৯-এ ফোনে উদ্ধার
গত ৩০ জানুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে কুড়িগ্রামের চিলমারীর থানাহাট ইউনিয়নের আকন্দপাড়া গ্রাম থেকে স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক গৃহবধূকে উদ্ধার করে পুলিশ। ভুক্তভোগী নারীকে তার স্বামী হাফিজুর রহমান ঘরে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করেন। খবর পেয়ে গৃহবধূর পরিবারের লোকজন এলেও তাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। পরে ওই গৃহবধূ ৯৯৯-এ কল করেন। সেই কলের সূত্র ধরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে ৯৯৯-এ কল করেন এক ভুক্তভোগী। দৌলতদিয়া যৌনপল্লি থেকে কল করেন তিনি। ফোনে আপ্লুত কণ্ঠে এক তরুণী কলার জানান, তার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী গুচ্ছগ্রামে। এক মাস ২৯ দিন আগে এক দালাল চাকরির প্রলোভন দিয়ে দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ করানো হচ্ছিল, রাজি না হলে মারধর করা হতো।
তরুণী ফোনে আরও জানান, তার কাছে কোনো ফোন নেই। একজনের ফোন থেকে তিনি ৯৯৯- এ কল করেছেন। ৯৯৯ থেকে তাৎক্ষণিক কলারের সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ডিউটি অফিসারের কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই তরুণীকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নিয়ে আসে। পরে আদালতের অনুমতির মাধ্যমে মেয়েটিকে সেফ হোমে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন>> স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ৯৯৯ নম্বরে ঘরছাড়া তরুণের ফোন
চাঁদপুর সদর থানা এলাকায় একটি বাসায় আটকে রেখে দীর্ঘদিন ধরে এক তরুণীকে জোরপূর্বক যৌনতায় বাধ্য করেন এক দম্পতি। সর্বশেষ এ অত্যাচার থেকে বাঁচতে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে সাহায্য চান ভুক্তভোগী তরুণী। পরে ৯৯৯-এর ফোনে চাঁদপুর সদর থানা পুলিশ ওই ভুক্তভোগী তরুণীকে উদ্ধার করে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ১৮ বছরের ওই তরুণী ৯৯৯-এ কল করেন। ভুক্তভোগী জানান, তার বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানায়। সাড়ে তিন মাস আগে মাহি ও মাহির স্বামী রিপন তাদের বাসায় কাজের কথা বলে তাকে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাকে দিয়ে ঘরের কাজের পরিবর্তে জোর করে যৌনতায় বাধ্য করানো হচ্ছিল। এ ধরনের কাজ করতে অস্বীকার করলে তাকে মারধর করা হতো। পরে তিনি এক খদ্দেরের ফোন থেকে টয়লেটে লুকিয়ে ৯৯৯-এ ফোন করেন। তিনি কল করে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান।
গত বছরের ৯ মে ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার দুমকি ইউনিয়ন পরিষদের দুই নম্বর ওয়ার্ডের একটি বাড়িতে ১৫ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করে পুলিশ। ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রীর একজন প্রতিবেশী ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে জরুরি পুলিশি সহায়তার জন্য অনুরোধ জানান। তাৎক্ষণিকভাবে দুমকি থানা পুলিশের একটি দল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে এবং ছাত্রীর বাবাকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করে।
আরও পড়ুন>> ৯৯৯-এ ফোনে কাপ্তাই লেকে আটকেপড়া ১৭৫ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উদ্ধার
২০২২ সালে ৯৯৯-এ সর্বোচ্চ ১২টি সেবার পরিসংখ্যান
ওই বছর মারামারি সংক্রান্ত কারণে ফোন করে সেবা পান ৭৮ হাজার ৮৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফোনকলে সেবা দেওয়া হয় দুর্ঘটনাজনিত কারণে ২২ হাজার ১২৫ জনকে। জমিজমা সংক্রান্ত কারণে তৃতীয় সর্বোচ্চ কল করেন ২১ হাজার ৯৪৭ জন। এরপর রয়েছে উচ্চস্বরে গানবাজনা ও মাইকিংসহ বিভিন্ন শব্দদূষণ সংক্রান্ত কারণে ফোন। এসব কারণে কল করেন ২০ হাজার ৬১১ জন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় ২০ হাজার ২৫১ জন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত কারণে ১৮ হাজার ৪৬২ জন, জরুরি চিকিৎসাসেবাজনিত কারণে ১৮ হাজার ৩৯২ জন, পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত কারণে ১৭ হাজার ৮৯ জন, অগ্নিকাণ্ড সংক্রান্ত কারণে ১৩ হাজার ৫৩৫ জন ও চুরি সংক্রান্ত কারণে ৯৯৯-এ ১২ হাজার ৩৩৩ জন কল করেন।
এছাড়া আত্মহত্যার ঘটনায় ফোন করেন ১ হাজার ৪৫৯ জন এবং আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনায় ফোন করেন ২ হাজার ৩২৭ জন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৯৯৯-এর পরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) আনোয়ার সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, একজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯৯৯-এ কল করেন। কল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে থানা পুলিশ গিয়ে ভুক্তভোগী গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। ৯৯৯ না থাকলে হয়তো ওই গৃহকর্মী ঘটনাটি চেপে যেতেন। ৯৯৯ থাকায় আগের চাইতে সেবা পেতে সহজ হয়েছে। অনুরূপভাবে সমাজের উচ্চপর্যায় থেকেও ৯৯৯ নম্বরে ফোনকল আসে। ভুক্তভোগী একজন সরকারি নারী চিকিৎসক। তার স্বামী সমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। ওই নারীও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯৯৯ -এ কল করেন। পরে থানা থেকে পুলিশ গিয়ে তার সমস্যা সমাধান করে। সমাজের উচ্চপর্যায় থেকে যেমন ৯৯৯-এ কল আসছে, তেমনি প্রান্তিক পর্যায় থেকেও প্রতিনিয়ত সেবার জন্য কল আসছে।
আরও পড়ুন>> প্রাণ দিতে লাইভে এসে প্রস্তুতি, ৯৯৯-এ কল পেয়ে উদ্ধার
তিনি বলেন, ৯৯৯ এর দোষ-ত্রুটি বের করার জন্য আমাদের একটি টিম কাজ করে। কীভাবে সার্ভিস আরেকটু দ্রুত কিংবা ভালো দেওয়া যায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের দোষ-ত্রুটি বের করার চেষ্টা করি। ৯৯৯ এর কল পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যাবে না নারী নির্যাতন বেড়েছে। ৯৯৯ এর প্রতি মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এজন্য আগের তুলনায় মানুষ বেশি ফোন করছেন।
‘আগে যেখানে ৯৯৯-এ মোট কলের সংখ্যা ছিল ৫ থেকে ১০ হাজার, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার।’ যোগ করেন পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ৯৯৯ অনেক ইতিবাচক দিক। এ সেবার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ তাদের বিপদের মুহূর্তে পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছেন। শ্রেণি-পেশা ও সামাজিক অবস্থান, নির্বিশেষে নারী, শিশু, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীসহ সবাই পাচ্ছেন এ সেবা।
আরও পড়ুন>> গ্রামের নাম ৯৯৯!
তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে, শিশু ও নারী নির্যাতন, দুর্ঘটনা ও দুর্যোগসহ বিপদগ্রস্ত মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে সম্ভাব্য ও স্বল্পতম সময়ে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি সেবাপ্রার্থীর কাছে। অগণিত মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। ভুক্তভোগী উদ্ধারের পাশাপাশি প্রতিদিন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে শত শত অপরাধীর বিরুদ্ধে।
২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর চালু হয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। দিন দিন এর প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দেশের যে কোনো প্রান্তে বিপদগ্রস্ত মানুষ ৯৯৯ নম্বরে কল করলেই ছুটে আসছেন পুলিশ সদস্যরা। সহায়তা পাচ্ছেন সবাই। সন্ত্রাস, দুর্ঘটনা, বাল্যবিয়ে ঠেকানো, ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো বিপদের একটাই ভরসা ৯৯৯।
আরও পড়ুন>> চুরির পর ৯৯৯-এ ফোন করে সহায়তা চাইলেন চোর
তিনটি জরুরি সেবা- অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশি সেবা দিতেই ৯৯৯ এর পথচলা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষ প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছেন সরাসরি কল করে। একই সময়ে ৯০ জন সেবাপ্রত্যাশী নিতে পারেন সেবা। কাজ হয় তিন শিফটে। সমাজে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার, গৃহকর্মী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধে ৯৯৯ প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। ৯৯৯-এ ফোন করে ঝামেলা এড়িয়ে সহজে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা পাচ্ছে দেশের মানুষ।
টিটি/ইএ/এসএইচএস/এএসএম