ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘পারমাণবিক অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে হুমকি দেওয়া’

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ২২ মার্চ ২০২৩

অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান। কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। লিখছেন, গবেষণা করছেন বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ ও চলমান অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সহসাই থামছে না, এমনকি বিস্তৃতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: আগের পর্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ প্রশ্নে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি থেকে যায় কি না?

অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান: না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের ঝুঁকি থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। এমন হার্ড লাইনে কেউ যেতে চাইবে না।

পারমাণবিক তত্ত্ব নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে আমি পড়িয়ে আসছি। পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনামূলক তত্ত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি দিল্লি, যুক্তরাষ্ট্রে পেপারস উপস্থাপন করেছি। এর অনেক গভীর কনসেপ্ট রয়েছে।

সীমিত আনবিক যুদ্ধ, কী ধরনের আনবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তা বিস্তৃতি ঘটবে না, আবার যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার লেখকরা সীমিত আনবিক যুদ্ধে বিশ্বাস করে না, এরকম বহু মতবাদ আছে, লেখা আছে।

জাগো নিউজ: আপনার নিজের বিশ্বাস কী?

এম শাহিদুজ্জামান: আমার কাছে মনে হয়, পারমাণবিক অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে হুমকি দেওয়া। এই অস্ত্রধারীরা মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং তা চরম মাত্রায়। কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করবে না।

আক্ষরিক অর্থে যদি নাগাসাকি বা হিরোশিমার মতো ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা আর ব্যবহার থাকে না। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার তখনই জীবিত থাকে, যতক্ষণ এটি হুমকির মধ্যে থাকে। ব্যবহার হয়ে গেলে তা মরে যায়। মূলত, হুমকিতে নিয়ন্ত্রণে রাখা। ব্যবহার না করেই চাপ সৃষ্টি করা। হিন্দু ধর্মের দেবি কালি যেমন প্রচণ্ড মৃত্যু বা ধ্বংসের ভয় দেখায় ঠিক তেমন। দেবি কালিকে পূজা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে এ ধর্মের বিশ্বাসীরা। মাথার ওপরে সুতা দিয়ে তরবারি ঝুলিয়ে রাখার মতো।

রাশিয়া বা আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আগে তাদের অনেক ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে। ইউক্রেনের জন্য তো এ দুটি দেশ নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনবে না।

রাশিয়ানরা অত্যন্ত মেধাবী জাতি। হুমকির মাত্রাকে একটি বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় নিয়ে যাবে। আমেরিকা অনেকটা ভয়ে আছে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে। উত্তর কোরিয়ার মিসাইল ৪০ মিনিটে আমেরিকায় আঘাত হানতে পারবে। উত্তর কোরিয়া দায়িত্বহীন আচরণ ঘটায় কি না, তাই নিয়ে ভয়ে থাকে আমেরিকা। রাশিয়াকে অতো ভয় নেই।

আরও পড়ুন>> যুদ্ধে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে রাশিয়া-ইউক্রেন

আমাদের কিউবা সংকটের কথা মনে আছে। ১৯৬২ সালে কথা। আমেরিকা হুমকি দিলো ‘রাশিয়া যদি কিউবা থেকে তাদের পারমাণবিক মিসাইল না সরায়, তাহলে ১২ দিনের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।’ তখন সত্যি সত্যি পারমাণবিক যুদ্ধ হতো কি না, তা এখনো কেউ বলতে পারেন না। কিন্তু যত কাগজপত্র বের হয়েছে, তাতে প্রমাণ মেলে যে রাশিয়া যদি পারমাণবিক মিসাইল সরিয়ে না ফেলতো, তাহলে পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি হতো। যদিও রাশিয়া তখন অনেক পিছিয়ে ছিল। এরপরেও রাশিয়ার হাতে যা মজুত ছিল, তা দিয়ে আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস করে দিতে পারতো। জন এফ কেনেডির ওই হুমকির কারণে রাশিয়া ব্যাক করেছিল, আর পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল। হুমকিই এর ব্যবহার।

জাগো নিউজ: দক্ষিণ এশিয়াতেও এমন টেনশন বাড়ছে। ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনায় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হুমকি নাকি বাস্তব ভিত্তি আছে?

এম শাহিদুজ্জামান: এখানেও ঠিক হুমকি। নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অবশ্যই লক্ষণীয়। ভারত বহুবার পরিকল্পনা করেছে কাশ্মীর দখলের। পাকিস্তানের হাতে তখন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত হয়ে গেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভারত কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করলো একবার। তখন আমেরিকা ভারতকে নিভৃত করার চেষ্টা করে বলে, তোমরা জানো না যে পাকিস্তান এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। তখন ভারত থেমে যায়। যতই উত্তেজনা থাকুক, দেশ দুটি এখন পর্যন্ত বড় রকমের যুদ্ধে যায়নি। বলা যেতে পারে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণেই এক প্রকার ভারসাম্য আছে।

আরও পড়ুন>> রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: যেসব প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর

জাগো নিউজ: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই আছে। বিশেষ করে দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ ইস্যু ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই সীমান্তে সংঘাত অনিবার্য করে তোলে।

এম শাহিদুজ্জামান: সেটা ভিন্ন আলোচনা। আসলে যুদ্ধ করার মতো পাকিস্তানের হাতে কোনো টাকাও নেই। পাকিস্তানের আর্মি টিকিয়ে রাখার মতোও ফান্ড নেই। পাকিস্তান অনেকটাই দেউলিয়া। দেশটির ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে এত বড় সামরিক ব্যবস্থাপনা রাখার দরকার আছে কি না? যুদ্ধ করতে হলে সবার আগে অর্থের দরকার। ন্যাটো আর্থিক বা সামরিক সহায়তা না করলে রাশিয়া দুই সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেন দখল করে ফেলতো। ন্যাটো এভাবে এগিয়ে আসবে, রাশিয়া আগে থেকে অনুমান করতে পারেনি।

সুতরাং, ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক যুদ্ধ হওয়া প্রায় অসম্ভব।

জাগো নিউজ: ভারতে নির্বাচন এলে পাকিস্তান সীমানায় টেনশন বাড়ে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে বিজিপির জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি করতে হয়।

এম শাহিদুজ্জামান: আমার কাছে মনে হচ্ছে, ভারতের এই থিওরি এখন মার খাচ্ছে। বিজিপি যে কত বড় ব্যর্থ দলে রূপ নিচ্ছে, তা এখন সবাই জানেন। ধর্মীয় হিংসা ছড়িয়ে দেশটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গরিব কৃষকদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। কৃষকদের বিক্ষোভ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ফলে ভারতের পক্ষে যুদ্ধ করাও এখন সম্ভব না। নরেন্দ্র মোদীর ইমেজ খুব খারাপ। মোদী যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি করে করলে ইউরোপ-আমেরিকা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। ভারতের দরকার এখন তেল। রাশিয়ার ওপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তির ওপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে অধিক মাত্রায়। এ কারণে যা ইচ্ছা, তাই করার ক্ষমতা রাখে না দেশটি। ভারত সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ক্রয় করে। এই অস্ত্র কিনে দেশের ক্ষতি করছে, মানুষের ক্ষতি করছে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর ক্ষতি আনতে চাইবে না।

আর পাকিস্তানের অবস্থা তো আরও খারাপ। পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে ভয়েই ভারত যুদ্ধে জড়াবে না।

জাগো নিউজ: পারমাণবিক অস্ত্রে ভর করে কেমন কাটবে আগামীর বিশ্ব?

এম শাহিদুজ্জামান: এ অস্ত্রের মজুত বাড়বে। কমবে না। ইরানের হাতেও পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত হয়ে যাবে। সৌদি আরবের হাতেও আসবে। ইসরায়েল এখন প্রচণ্ড হুমকির মধ্যে থাকবে। ফিলিস্তানি জাতির অস্তিত্ব প্রায় মুছে ফেলেছে ইসরায়েল। এর মূল্য একদিন দিতেই হবে। পুরো আরব বিশ্বকে কিনে নেওয়ার পলিসি এখন বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের জন্য। আরব বিশ্ব এখন বুঝে গেছে। ইরানের জুজুর ভয় দেখিয়ে গোটা আরব বিশ্বকে জিম্মি করে ফেলেছে ইসরায়েল-আমেরিকা। দেখার বিষয় মিশর এখন কোন দিকে যায়? কারণ মিশরের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল যে চাইলেই বের হয়ে আসতে পারবে না।

আমেরিকার কথা ছিল অনেস্ট ব্রোকার (সৎ মধ্যস্থতাকারী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। তা করেনি। ইসরায়েলকে নিয়ে চরম বেঈমানি করেছে মুসলামানদের সঙ্গে। আমেরিকার বড় পরাজয় হচ্ছে ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা।

আমরা অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সৌদি আরবের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত মেধাবী। তিনি ইরানে বিশাল বিনিয়োগ করার পক্ষ নিয়েছেন। এটি ঘটলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব কেটে যাবে। এতে ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক অঞ্চলে যে দ্বন্দ্ব তা কমে আসবে। আগামী দুই মাস আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ এই সময়ে সিআইএ এবং মোসাদ নতুন পরিকল্পনা করার চেষ্টা করে সৌদি-ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বাড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে সেই ষড়যন্ত্র সফল হবে বলে মনে করি না। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা-ইসরায়েলের হাত-পা বাঁধা পড়ে গেছে।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম