দুবাই পালানোর আগে আরাভ খান থাকতেন কলকাতার বস্তিতে!
ধৃমল দত্ত, কলকাতা
বাংলাদেশের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মো. মামুন এমরান খান হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত আরাভ খান অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অধীন রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার ফরতাবাদ এলাকায়। আসল পরিচয় গোপন করে পাঁচ-ছয় বছর ছিলেন ফরতাবাদ এলাকার উদয় সংঘ ক্লাবের পাশের একটি বস্তিতে।
সেখানে জাকির খানের ভাঙাচোরা বাসার দোতলায় মাসিক ২ হাজার রুপিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন আরাভ ও তার স্ত্রী সাজেমা নাসরিন।
এরপর জাকির খান ও তার স্ত্রী রেহানা বিবি খানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন তারা। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েই জাকির ও রেহানার ভারতীয় আধার কার্ড সংগ্রহ করে তাদেরই কথিত বাবা-মা হিসেবে পরিচয় দিতেন। তাদের কাগজ কাজে লাগিয়েই আরাভ ভুয়া ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন বলে অভিযোগ।
সেই পাসপোর্ট দিয়ে দুবাই পালিয়ে যান পুলিশ খুনের আসামি আরাভ। এরপর থেকে গত কয়েক বছর দুবাইতেই অবস্থান করছেন আরাভ খান।
আরও পড়ুন: ফিরিয়ে আনা হবে আরাভ খানকে, কীভাবে দেশত্যাগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ
দিন কয়েক আগে এক ভিডিও বার্তায় দুবাইয়ে আরাভ জুয়েলারি নামে একটি শোরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানাতে দেখা যায় বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে। সাকিবের এই ভিডিও বার্তাটি ওই জুয়েলারির মালিক আরাভ খানের ফেসবুক পেজ থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি শেয়ার করা হয়।
এরপর ১৫ মার্চ আরাভ জুয়েলারি শোরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন শাকিব খানসহ দেশ-বিদেশের একাধিক সেলিব্রেটি। কিন্তু কার ডাকে তারা দুবাইয়ে পাড়ি দেন? কে এই আরাভ খান? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় নামের ব্যক্তিটি আদতে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মতিউর রহমান মোল্লা।
যদিও আরাভ ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেই গত কয়েক বছর ধরে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন বলেই অভিযোগ। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। ওই পাসপোর্টেই পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুরের ঠিকানা দেওয়া।
আরও পড়ুন: যে কারণে দুবাই যাচ্ছেন হিরো আলম
শুধু তাই নয়, তার স্ত্রী ভারতীয় নাগরিক (আসাম) সাজেমা নাসরিন এর পাসপোর্টটিও ভারতীয়। আরাভের কথিত বাবা-মা জাকির খান ও রেহানা বিবি খান-এর পাসপোর্টেও তাদের উভয়ের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে কন্দর্পপুর, উদয় সংঘ ক্লাব, রাজপুর-সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা-৭০০০৮৪।
কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস (ইএম বাইপাস) ধরে সোজা ফরতাবাদ মোড় থেকে বাম দিকে ৮০০ মিটার ভেতরে ঢুকলেই কন্দর্পপুর উদয় সংঘ ক্লাব। সেখানে জাকির খানের নাম বলতেই এক নারী এসে তার বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। বোঝাই গেলো, ওই এলাকায় যথেষ্ট পরিচিত নাম জাকির খান। যদিও বছর দুয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাকির। তার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা হলো তার স্ত্রী রেহানা বিবি খানের সঙ্গে।
প্রথমে মুখ খোলার ব্যাপারে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয় দিতেই কিছুটা স্বাভাবিক হন রেহানা। মোবাইলে আরাভের ছবি দেখতেই রেহানা জানান, ৫ বছর আগে আমাদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছিল। আমাদের বাসায় এক বছর ভাড়া ছিল, এরপর চলে যায়। এ সময় মাসিক ২ হাজার রুপি করে ভাড়া দিত।
রেহানার দাবি, তাদের আধার কার্ড নিয়ে আরাভ কি একটা কাগজ তৈরি করবে বলেছিল। সে কারণে আমি ও আমার স্বামী উভয়ই আরাভকে আমাদের আধার কার্ড দিয়ে দিই।
‘সেই ভারতীয় আধার কার্ড দিয়েই নিজের স্ত্রীর ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেছিল আরাভ খান। যদিও তাকে কোনো দিনই সন্দেহ হয়নি। মালিকের সঙ্গে একজন ভাড়াটিয়ার যে সম্পর্ক থাকে, আমাদের সঙ্গেও আরাভ খানের সেই সম্পর্ক ছিল। আজ সকালেই আমি ইউটিউবে আরাভ খানের দুবাই যোগের বিষয়টি জানলাম।’
রেহানার দাবি, এলাকার লোকজনের সঙ্গেও খুব একটা মেলামেশা করতেন না আরাভ। বাইরেও তেমন বের হতেন না।
আরও পড়ুন: প্রয়োজনে সাকিব-হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে: হারুন
তবে এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আরাভকে চিনতেন। বিএমডব্লিউ মোটর সাইকেলে করে এলাকায় স্টান্ট করতেও দেখা যেত তাকে। আরাভ নিজেকে একজন ফিল্ম আর্টিস্ট বলে পরিচয় দিতেন। এমনকি তার কথিত মা রেহানা বিবি খানও আরাভকে আর্টিস্ট বলেই জানতেন।
২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খানকে হত্যার পর পেট্রল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরে এক জঙ্গলের ভেতর ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন আরাভ খান। তখন থেকেই পলাতক তিনি। পরে জানা যায় প্রকৃত আসামি আরাভের পরিবর্তে সে সময় কারাগারে যায় আবু ইউসুফ লিমন নামে এক স্থানীয় যুবক।
এদিকে বাংলাদেশের ডিবিপ্রধান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম একজন খুনি। একজন মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তাকে খুন করেছেন। মিডিয়ায় ও অনেকের বলার পরও সাকিবসহ অন্য তারকারা খুনের মামলার আসামির ডাকে দুবাইয়ে গেছেন। তার সোনার দোকান উদ্বোধনে যোগ দিয়েছেন।
আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে ইন্টারপোলের সহায়তায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো, যোগ করেন ডিবিপ্রধান।
এমএইচআর/জিকেএস