মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র
জুনে পরীক্ষামূলক উৎপাদন, ডিসেম্বরে পুরোদমে চালু
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। চলমান কর্মযজ্ঞের অনেকটাজুড়ে এখন মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দেশের সবচেয়ে বড় চিমনি উঁচিয়ে সংকটে বড় ভূমিকা রাখার তাড়ায় যেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ এগোচ্ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী জুনের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোদমে চালু হবে এটি, তখন জাতীয় গ্রিডে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে।
আরও পড়ুন: মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়লো
এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার প্রস্থের চ্যানেল করা হয়েছে। চ্যানেলের একেবারে শেষ প্রান্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। চ্যানেলের দুপাশে চলছে সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তুতি।
চ্যানেলের শেষ প্রান্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব জেটি। সমুদ্রপথেই বিদেশ থেকে কয়লা আনা হবে। ৮০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন মাদার ভেসেল এসে সরাসরি ভিড়বে জেটিতে। জাহাজ থেকে সরাসরি কয়লা চলে যাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ফলে এতে কোনো পরিবহন ব্যয় হবে না, সময়ও নষ্ট হবে না। কম খরচে উৎপাদন হবে বিদ্যুৎ।
আরও পড়ুন: ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভূমি অধিগ্রহণেই ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি
কয়লা রাখার ইয়ার্ড নির্মাণও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বহু দূর থেকে দেখা যায় ২৭৫ মিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনি। বালুময় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে নানা স্থাপনা নির্মাণকাজ।
মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মূল কাজ শুরু করে জাপানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এক হাজার ৬০৮ একর জমিতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিশ্বের সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এ প্রকল্পে। কয়লাভিত্তিক হলেও এই কেন্দ্র পরিবেশগতভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, কয়লা রাখার স্থানটি পুরোপুরি ঢাকা থাকবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা লাগবে। নির্মিত ইয়ার্ডে ছয় মাসের কয়লা মজুত রাখা যাবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে মোজাম্বিক, অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। আপাতত অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়াকে কয়লা আনার জন্য বাছাই করা হয়েছে। তাছাড়া এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
আরও পড়ুন: কাজ কমলেও বাড়ছে ব্যয়, জাইকার ঋণ দাঁড়ালো ৭৯১ কোটি
কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই (অ্যাশ) ব্যবস্থাপনার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই মজুত রাখার জন্য অ্যাশপন্ড (ছাই রাখার আধার) করা হয়েছে। দুটি অ্যাশপন্ডের একটির আয়তন ৯০ একর, আরেকটি ৬০০ একর জুড়ে। প্রকল্পের আওতায় টাউনশিপ নির্মাণ হচ্ছে। বয়লার, টারবাইন জেনারেটর এবং প্রি-কমিশনিংয়ের আনুষঙ্গিক কাজও চলমান রয়েছে।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমরা কয়লা আনছি। কয়লা দিয়ে ফায়ারিং শুরু করবো। জুন মাসে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রিডে বিদ্যুৎ দেবো এবং ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোদমে শুরু হবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, আমরা পাওয়ার প্ল্যান্টে ২৭৫ মিটার দীর্ঘ একটি চিমনি করেছি। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু চিমনি। এছাড়া কয়লা রাখার জন্য ইয়ার্ডের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য সেখান ছয় মাসের কয়লা মজুত করা যাবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিনি ১০ হাজার টন কয়লা লাগবে।
আরও পড়ুন: রেল যাবে মাতারবাড়ি, গাজীপুরে ওয়ার্কশপসহ মহাপরিকল্পনা
‘এখানে কয়লা এসে জাহাজ থেকে সরাসরি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে যাবে। জাহাজ থেকে কয়লা নামবে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে যাবে, কোথাও কয়লা দেখা যাবে না। এটা শতভাগ সিলড করা থাকবে, কাভার্ড থাকবে। কেউ দেখলেও বুঝতে পারবে না যে, এটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কোথাও কয়লার চিহ্ন থাকবে না’- যোগ করেন তিনি।
নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, এখানে কয়লা পরিবহন ব্যয় খুব কম হবে। তাই অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও কম হবে।
পুরোদমে চালু হলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলেও জানান আবুল কালাম আজাদ।
আরও পড়ুন: ৫০ বছরে বিদ্যুৎখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া ‘মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার’ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এখন এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে ২০১৪ সালের ১৬ জুন ঋণচুক্তি করা হয়। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দিচ্ছে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি ৩ লাখ টাকা, অবশিষ্ট ৭ হাজার ৯৩৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএলের নিজস্ব তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের কনসোর্টিয়াম এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনসোর্টিয়াম) ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।
আরএমএম/এমকেআর/জেআইএম