নভোএয়ারে লক্ষ্য এবার আন্তর্জাতিক রুটে সফলতা অর্জন: এমডি
দেশের বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা নভোএয়ার গত ৯ জানুয়ারি দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল এ সংস্থাটি। গত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে এক লাখের বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে নভোএয়ার। এ সময়ে সব মিলিয়ে সেবা দিয়েছে সাড়ে ৫৫ লাখের বেশি যাত্রীর। ভবিষ্যতে যাত্রীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা অব্যাহত রাখতে চায় এয়ারলাইন্সটি।
নিজেদের এক দশকের অগ্রযাত্রা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দেশের অ্যাভিয়েশন খাতের নানান বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুসা আহমেদ।
জাগো নিউজ: এক দশক অতিক্রম করলো নভোএয়ার। আপনাকে অভিনন্দন। দীর্ঘ এ যাত্রা কেমন ছিল?
মফিজুর রহমান: ধন্যবাদ। নভোএয়ার এয়ারলাইন্স হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি। তবে এর প্রস্তুতি ২০১১ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। সে সময়টায় আমরা দেখেছি আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্স সেবা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অপ্রতুল। ফলে যাত্রী চাহিদা, সেবার মান এবং নিরাপত্তা- এই তিনটি জিনিসের ঘাটতি ছিল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভ্যন্তরীণ রুটে এমন একটি এয়ারলাইন্স করা যেটি সাসটেইনেবল হবে। যাত্রী নিরাপত্তা, কাঙ্ক্ষিত সেবা ও যাত্রীরা যাতে সহজভাবে এয়ারলাইন্স ব্যবহার করতে পারেন সেটি নিশ্চিত করতে আমরা এয়ারলাইন্স হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখন আমরা দশ বছর সেলিব্রেশন করছি।
জাগো নিউজ: নভোএয়ারের ১০ বছর পথচলা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মফিজুর রহমান: বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স একটা পর্যায়ে গিয়ে স্থবির হয়ে যায়। সেটা একটা এয়ারলাইন্সের আর্থিক অপচয়। এর সঙ্গে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায় হাজারো চাকুরের। সেজন্য আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি সাসটেইনেবল এয়ারলাইন্স গঠন করা। পাশাপাশি সেবার মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১০ বছরের পথচলায় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ইনশাআল্লাহ আমরা সার্থক। সেবা ও নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা সেটা নিশ্চিত করেছি। সেটার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় স্বীকৃতি আছে। আমাদের যাত্রীদেরও স্বীকৃতি আছে যে, নভোএয়ারের সার্ভিস ও নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি নেই। চেষ্টা করে যাচ্ছি এ সেবা ও নিরাপত্তার মান আরও উন্নয়ন করতে।
জাগো নিউজ: নভোএয়ার এখন ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি এয়ারলাইন্স। আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মফিজুর রহমান: আমাদের মূল পরিকল্পনা ছিল দেশের অভ্যন্তরে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সেবা দেওয়া, সেটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। এ অর্জনটাই সামনের দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা ধাপে ধাপে এগোনোর পরিকল্পনা করছি। প্রথমত, কিছুসংখ্যক ‘ন্যারো বডি’ উড়োজাহাজ দিয়ে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ফ্লাইট পরিচালনা করতে চাই।
একইভাবে মাস্কাট, শারজাহ, দুবাই, দোহার মতো গন্তব্যগুলোতেও নেটওয়ার্ক বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে কলকাতায় ফ্লাইট পরিচালনা করছি। দিল্লি, চেন্নাই, আগরতলা, শিলং, আসাম, গুয়াহাটিকেও নভোএয়ারের নেটওয়ার্কে আনার পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে নভোএয়ারের বহরে ৭২ আসনের এটিআর ৭২-৫০০ মডেলের ৭টি নিজস্ব উড়োজাহাজ রয়েছে।
জাগো নিউজ: ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ রোধে দীর্ঘদিন এয়ারলাইন্সে যাত্রী পরিবহন বন্ধ ছিল। এতে অ্যাভিয়েশন খাত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানি। করোনা পরবর্তীসময়ে নভোএয়ার কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে?
মফিজুর রহমান: করোনার একটা দীর্ঘ অভিঘাত ছিল। সেই সময় সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের এয়ারলাইন্স আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো সরকার সাপোর্ট দিয়েছে। কর্মচারীদের বেতনও সরকার থেকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেটা আশা করি না। তারপরও ওই সময়ে আমরা কিন্তু কোনো লোকবল ছাঁটাই করিনি। সবাইকে রেখে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। ফলে আমাদের লোকসান হয়েছে।
কিন্তু যখন করে দাঁড়াতে শুরু করেছি, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেঁধে গেলো। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, তেলের দাম বেড়ে গেলো ১৫০ শতাংশের বেশি। এভাবে আমাদের খরচ বেড়ে গেলো। কিন্তু টিকিটের মূল্য সেভাবে বাড়ানো যায়নি। গত বছরের মার্চ থেকে আবার সেই বোঝা টেনে নিয়ে আসছি। আমরা আশা করছি ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি হবে। তেলের দামটা যদি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে এবং ডলার যদি একটা পর্যায়ে থাকে তবে কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। এখন আমরা লোকসানে আছি।
জাগো নিউজ: অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অসম প্রতিযোগিতার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এতে আপনারা কোন ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছেন?
মফিজুর রহমান: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সরকারি মালিকানায় থাকা একটি কোম্পানি। সিভিল অ্যাভিয়েশনের কাছে বিমানের আট হাজার কোটি টাকা দেনা। পদ্মা অয়েলের কাছে দেনা পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এত দেনা রেখেও তারা সস্তায় যাত্রী পরিবহন করছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকেও বাধ্য হয়ে কম দামে টিকিট বিক্রি করতে হচ্ছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়, অন্যদিকে বিমানের কারণে টিকিটের দামে বাধ্য হয়ে ছাড় দেওয়ায় বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো টিকে থাকতে পারছে না।
বড় প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাজারে এসেও জিএমজি, ইউনাইটেড, রিজেন্টের মতো এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এখানে বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি একটি সুস্থ ও প্রাণবন্ত অ্যাভিয়েশন খাত চাই, তাহলে সবার আগে এ অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে হবে।
জাগো নিউজ: গত দুই বছরে জেট ফুয়েলের দাম প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। কোনো অগ্রগতি আছে?
মফিজুর রহমান: জেট ফুয়েল ফ্লাইট পরিচালনা খরচের প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে জেট ফুয়েলের দাম বাড়লে তা এয়ারলাইন্স পরিচালনার ওপর প্রভাব ফেলে। এখন আমরা দেখছি বিশ্বে যে গতিতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছিল এখন আবার কমেছে। কিন্তু আমাদের এখানে যে সমস্যাটা হয়, তেলের দাম বাড়ানো হয় কিন্তু তা আর কমানো হয় না। আমরা সব সময় বিশ্ববাজারের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি দিয়ে তেল কিনি। যেটা যৌক্তিক নয়। এর মধ্যে আবার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোতে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি দিয়ে তেল কিনি। এই দাম কমাতে আমরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দেন-দরবার করছি। বিশেষ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটির কাছে আবেদন করেছি। তারা মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দেখবেন। এটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবেন।
জাগো নিউজ: অভ্যন্তরীণ রুটে লোকসানের কথা সব সময়ই বলে আসছেন। আসলে বাস্তবতা কী?
মফিজুর রহমান: অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনায় আসলেই লোকসান হচ্ছে। যারা আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা সেখানের আয় দিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চালাচ্ছে। আর আমরা লোকসান মেটাচ্ছি আমাদের সিস্টার কনসার্ন অন্য কোম্পানি থেকে। মূলত সবাই কিন্তু অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে লোকসানে আছে। একটা সময় কিন্তু ২০১৯ সালের দিকে বাজারটা ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে বিস্তার লাভ করেছিল। এখন কিন্তু সেটা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। বরিশালে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। যশোরে যাত্রী কমে গেছে। ভবিষ্যতে এটা আরও সংকোচন হবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ রুটের সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট চলে কক্সবাজারে, যেটা চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল চালু হলে অল্প সময়ে কক্সবাজার যাওয়া যাবে। এছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন চালু হচ্ছে। অনেক যাত্রী ট্রেনে যাবে। এর প্রভাব উড়োজাহাজে গিয়ে পড়বে।
জাগো নিউজ: উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশের উচ্চ করহারসহ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক নিয়ে অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টরা সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করছে। তাতে কি কোনো লাভ হয়েছে?
মফিদুর রহমান: আমরা অদ্যাবধি এ বিষয়ে খুব একটা সাড়া পাইনি। বরং নতুন করে কিছু ভ্যাট ও ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে অগ্রিম ট্যাক্স, অগ্রিম আয়কর ইত্যাদি মিলিয়ে এখনো আমরা ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েই যাচ্ছি। যেখানে বিশ্বব্যাপী এয়ারক্রাফটের স্পেয়ার পার্টসগুলো শূন্য ট্যাক্সে আমদানি করতে দেয়। অথচ আমাদের বিভিন্ন স্তরে ২৬ শতাংশ এখনও দিতে হয়। কিছু কিছু স্পেয়ারে দেড়শ-দুইশ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। এভাবে একটা শিল্প এগিয়ে যেতে পারে না।
জাগো নিউজ: দেশি এয়ারলাইন্স আর কী ধরনের সমস্যায় আছে?
মফিজুর রহমান: আমাদের নিয়ে সরকারের সবাই খুবই আন্তরিক। কিন্তু দেশের আইন-কানুন প্রণয়নে যে অবস্থা, এটা কিন্তু খুবই দুঃখজনক, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদেরও আপডেট করা দরকার। এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা।
জাগো নিউজ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মফিজুর রহমান: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম