ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

যুদ্ধ-মহামারি

২০২৩ সাল কিছুটা স্থিতিশীল পাবো

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৬:০২ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০২৩

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।

আসছে বছর কেমন যাবে বিশ্ব- এ প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: করোনা মহামারি আর যুদ্ধ পরিস্থিতি সমানতালে বিষিয়ে তুলছে বিশ্বকে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলছে পৃথিবীকে। ২০২৩ সালে কী দেখছেন?

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: আসলে ভবিষ্যৎ নিয়ে সঠিক ধারণা প্রকাশ করা মুশকিল। করোনা মহামারি মানুষকে এভাবে ভাবিয়ে তুলবে তা কি কেউ ধারণা করেছিল! চীনে ফের মহামারি আতঙ্ক। দেশটিতে প্রচুর জনসংখ্যা। আসলে কী ঘটছে তার সঠিক খবরও নেই। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, করোনার প্রভাব কিছুটা কমে আসছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু তার প্রভাব আগের মতো হবে না। এই শীতের মৌসুম চলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। এরই মধ্যে চীনের অভ্যন্তরে সব খুলে দেওয়া হয়েছে। চীনে যাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়, তারা আসলে খুব ভয়ের কথা আর বলছেন না।

করোনা মহামারি সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে সাবধানতা অবলম্বন করে।

চলতি বছর বিশ্বকে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে এই যুদ্ধে ইউরোপিয়ানরা আগের অবস্থানে নেই বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে। তারা এক ধরনের কাঠামো তৈরি করতে চায়, যেখানে সমাঝোতার পথ বের হতে পারে। রাশিয়া পুরো ইউক্রেন দখল করবে এটি যেমন হিসাবে নেই, তেমনি পশ্চিমারা ইউক্রেনে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করবে এটিও হিসাবে নেই। এ দুটি কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বড় আকারে বাড়বে, তা মনে করি না। এই যুদ্ধ ঘিরে যে স্যাংশনস তা বেশিরভাগ দেশই ভালোভাবে নিতে চাইছে না।

আবার জানুয়ারি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা নিম্নকক্ষ দখলে নেবে। এটি একটি বড় পরিবর্তন এবং জো বাইডেনের পরিকল্পনাকে কিছুটা থামিয়ে দেবে। সুতরাং, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তা আগামীতে আরও খারাপ হবে তা মনে হচ্ছে না। এই যুদ্ধ সাংঘাতিক রূপ নেবে না সম্ভবত। মহামারিও নয়। এই দুটি কারণে ২০২৩ সাল কিছুটা স্থিতিশীল পাবো।

জাগো নিউজ: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশেষত ইউরোপকে কী বার্তা দিলো?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ইউরোপের চালিকাশক্তি অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র। এই জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন আসতে বাধ্য। এই পরিবর্তন আগামী বছরই হবে, তা নয়। সময়ও লাগতে পারে। রাশিয়া থেকে ইউরোপে যে পাইপলাইন, তা বন্ধ করেছিল। এখন তা আবার চালু করছে। ইউরোপ হয়তো চেষ্টা করছে কৌশলগত এক ধরনের কর্তৃত্ব তৈরির। ইউরোপের উন্নয়ন ব্যাপক। এখানে আঘাত হানলে বহুদিন লাগবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে। এ কারণে ভারসাম্যও চাইছে। ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অন্ধভাবে ঝুঁকে থাকবে, এটি আমি আর মনে করছি না। নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে।

জাগো নিউজ: যুদ্ধ আর যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একাকার। আগামীতে যুদ্ধের পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের মেজাজ বুঝতে পারছেন কি না?

ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যে কাঠামো সেখানে হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা, না হয় যুদ্ধের প্রয়োজন। তার সামরিক বাজেট ৯শ বিলিয়ন ডলার প্রায়। এই বাজেটের মধ্য থেকে বড় একটি অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র তৈরিতে। অস্ত্র তৈরি করে কী করবে যদি তার ব্যবহার না হয় বা বিক্রি করতে না পারে। ব্যবহার করতে হলে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। আর বিক্রি করতে চাইলে যুদ্ধ পরিস্থিতি দরকার।

ডোনাল ট্রাম্প অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই কাঠামোর বাইরেও চিন্তা করেছিলেন। এ কারণে বলেছিলেন, ইউরোপ কেন সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে না? যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কেন নির্ভর করছে? ইউরোপের সামরিক ব্যয় কেন যুক্তরাষ্ট্র বহন করবে? ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের বহু সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে প্রচুর ব্যয় করতে হয় দেশটিকে।

এ নিয়ে আমেরিকার মধ্যেই দ্বিমত আছে। ইউরোপ সামরিকভাবে শক্তিশালী হলে আমেরিকাকে আর মূল্য দেবে না বলে কেউ কেউ মনে করেন। এই প্রশ্নে পরিবর্তন না এলে বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে বলেও মনে করি না।

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধের কিছুটা আভাস মিলছে। কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক, চীন-তাইওয়ান টেনশন থেকে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, যাতে এখানকার দেশগুলো সামরিক ব্যয় বাড়ায় জাপান, অস্ট্রোলিয়া অস্ত্র কিনতে শুরু করেছে। এশিয়ায় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র কতদিন চালিয়ে যাবে?

কারণ, চীন এখন বড় শক্তি হয়ে উঠছে। রাশিয়াও বড় শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রকে এসব ভাবতে হচ্ছে। তাই অনুমান করে আসলে যুদ্ধের ছক বলে দেওয়া যাচ্ছে না।

জাগো নিউজ: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার টেনশন বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে। ভারতের নির্বাচনের সঙ্গেও এ টেনশন কাজ করে আসছে। সামনে কী দেখছেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারত ও পাকিস্তান- দুটিই পরাশক্তি এখন। এ কারণে তারা প্রক্সি ওয়ারের (পরোক্ষ যুদ্ধ) মধ্যে থাকবে। সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে যাবে না। পাকিস্তান মাঝে মধ্যে ভারতের ভেতরে জঙ্গি হামলা চালানোর চেষ্টা করবে, যা আগে করেছে। ভারত পাল্টা হামলা করবে। টেনশন থাকলেও ভারসাম্য থাকবে। কারণ টেনশন বাড়লে মহাবিপদ ঘটবে এখানে। দুটি দেশই খুব কাছাকাছি। একে অপরের ভূখণ্ডে পারমাণবিক বোমা ফেললে সর্বোচ্চ ক্ষতিটাই হবে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কেউ দেখতে চাইবে না। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব থাকলেও অস্ত্র বিক্রি করা যায়। যদিও এই পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লায় পড়ে পাকিস্তানের ক্ষতিটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

তবে যুদ্ধ নিয়ে আসলে কিছুই বলা যায় না। আফগানিস্তানের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হবে কেউ ভাবতে পারেনি। কী ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে হলো।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি দিচ্ছে। পাল্টা বিবৃতি দিলো রাশিয়া। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় এমনটি না হওয়া বরং অস্বাভাবিক। আগে তো আরও বেশি হতো। চায়ের দাওয়াত, ডিনার। আজ এক রাষ্ট্রদূতের বাসায় তো কাল অমুক নেতার বাসায়। মিডিয়া ছুটে যেত। নির্বাচন ঘিরে এমন হয়। এখন হয়তো বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।

সরকারও এখন সচেতন। তবে কূটনীতিকরা এমনিতেই বিবৃতি দিচ্ছেন, তা মনে করি না। তাদের প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হচ্ছে। অনেক লবি কাজ করে এসবে। তবে বর্তমান বিশ্বে বহুমুখী শক্তির উত্থান ঘটছে। এ কারণে আমেরিকা ভালো করে জানে, তার একতরফা খবরদারি খাটবে না।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কথা বলেছে, সে ব্যাপারে তার নিজের ভেতরেই ঘাটতি আছে। আর বৈশ্বিকভাবে তো যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলছে। ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানে কী করলো আমেরিকা!

আমেরিকা তার বিদেশনীতি থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকা যে কথা বলছে, তার সুযোগ আমরাই করে দিচ্ছি। আমাদের বিভাজনের রাজনীতি থেকে এমন সুযোগ তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান আর বিদেশি শক্তির বিবৃতি নিয়ে বিশ্লেষণ করলেই সব পরিষ্কার হবে।

জাগো নিউজ: এমন অবস্থানে আসলে কী ফল আসবে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বিদেশিরা ঠিক করে দিয়েছে, এমন নজির নেই। যেটুকু গণতন্ত্র আমরা পেয়েছি, তা এখানকার মানুষের লড়াই-সংগ্রামের ফল। ভাষা আন্দোলন থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান তো এদেশের মানুষের আন্দোলনের ফল।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশিদের দিয়ে আসলে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারব কি না? বিদেশিদের দিয়ে গণতন্ত্র ভালো হবে না।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের করণীয় কী?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমার মনে হয় না বাংলাদেশ আর এমন খবরদারি বরদাস্ত করবে। যারা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিচ্ছে, সরকার সেখানে নজরদারি বাড়াবে।

জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ীই সরকার নানান ব্যবস্থা নিতে পারে। সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে কিন্তু কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ কিছুটা কমেছে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বিদেশিদের এমন আচরণ মেনে নেওয়ার কথা নয়।

যারা রাজনীতি করছেন, পরিবর্তন করতে চান তাদের উচিত জনগণের ওপর ভরসা রাখা। জনগণের ওপর বিনিয়োগ করুন। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে অনেক কিছুর পরিবর্তন দরকার। পদ্ধতির পরিবর্তন, পরিপত্রের পরিবর্তন জরুরি। এটি নিয়ে তো দেশের মানুষকেই কথা বলতে হবে। এখানে নির্বাচন মানেই টাকার খেলা। টাকার প্রবাহ বন্ধ হলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।

জাগো নিউজ: বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার চীন-রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত কীভাবে দেখছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এটি বলা মনে হয় ঠিক হবে না। কারণ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। নিরাপত্তা, গোয়েন্দা, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আমাদের বহুদিনের সম্পর্ক। নাগরিক স্তরেও সম্পর্ক রয়েছে।

এমন সম্পর্কের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কী করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত একটি রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যান, যেটি একটি দলের এজেন্ডার সঙ্গে সম্পৃক্ত! যারা তাকে নিয়ে গেছেন, হয় তারা জেনেশুনে করেছেন, না হয় অন্য ঘাটতি আছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে এমনই সন্দেহ আছে।

আবার এমন একটি ঘটনা ঘটছে বলেই বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক একেবারে খারাপ হয়ে যাবে, এমন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকার আমেরিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথবা চীন বা রাশিয়ার জন্য কোনো সামরিক ঘাঁটিও তৈরি করে দেয়নি।

তবে সম্প্রতি রাশিয়া যে বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে আমেরিকারও টনক নড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে অন্যরা যে খবর রাখছে, তা অনেকটা আমেরিকার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে যে বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলছে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আর বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে।

এএসএস/এএসএ/জিকেএস