‘গতির ঝড়’ তুলতে মোটরসাইকেলে প্রাণ ঝরছে শিশু-কিশোরদের
#লাইসেন্স ছাড়াই শিশু-কিশোররা মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে কীভাবে?
#সন্তানের আবদারে ‘মৃত্যুফাঁদ’ মোটরসাইকেল দিচ্ছেন অভিভাবকরা
#বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেলে বেপরোয়া ছুটছে অনেক কিশোর
# দ্রুতগতিতে চালানোর দৃশ্য ভিডিও ধারণ করতে গিয়েও ঘটছে দুর্ঘটনা
মোটরসাইকেল এখন একটি প্রাণঘাতী বাহনে পরিণত হয়েছে। উচ্চগতির মোটরসাইকেল বেপরোয়াভাবে চালাতে গিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। দুর্ঘটনার কবলে পড়াদের বড় একটা অংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এমন অল্পবয়সী শিশু-কিশোরদেরদের সড়কে যানবাহন চালানোর কোনো বৈধতা নেই। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮। অথচ সড়কে মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেরানোদের অনেকেরই বয়স আঠারোর কম।
এমন ঘটনা অহরহ দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর, সকাল ৬টা। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় লিটন (১৫) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। গতির ঝড় তুলতে গিয়ে প্রাণ হারায় এই স্কুলছাত্র। নিহত লিটন ফলদা রামসুন্দর ইউনিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। এ ঘটনায় তার সহপাঠী দুই বন্ধু শাওন ও মারুফসহ পথচারী জয়নাল আহত হয়।
চলতি বছরের ৬ জুলাই দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল ছয় বন্ধু। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার একটি সড়কে টিকটকের জন্য মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে চালানোর দৃশ্য মোবাইলফোনে ভিডিও ধারণ করছিল তারা। এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আহত তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত্যু হয় এক কিশোরের।
রাজশাহীর তাহেরপুর-শিকদারী সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আফিফ হোসেন (১৫) জামগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। দুর্ঘটনায় আহত অন্য দুজনও এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী।
আরও পড়ুন: জোরে মোটরসাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতায় প্রাণ গেলো ৩ যুবকের
‘মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা’ অথবা ‘বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্রের মৃত্যু’। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ দুই শিরোনামে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশ হয়।
তবুও একশ্রেণির অভিভাবক সন্তানের আবদার মেটাতে ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ মোটরসাইকেল’ তুলে দিচ্ছেন প্রিয় সন্তানের হাতে। অনেক সময় মোটরসাইকেলের প্রতি সন্তানের ঝোঁক দেখে জেএসসি অথবা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার আশ্বাসও দেন এসব অভিভাবক।
এছাড়া রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে কিশোর-যুবকরা। তারা মোটরসাইকেলে মহড়া দিচ্ছে হেলমেট ছাড়াই।
বর্তমানে কিশোর ও যুবকদের কাছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বেশ লোভনীয়। উঠতি বয়সী এসব শিশু, কিশোর ও যুবকরাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বেশি। বাইকে চড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব কিশোর, তরুণ ও যুবক। তাদের মোটরসাইকেলের গতি থাকে সর্বোচ্চ। গতি দেখে ভয় পাচ্ছেন পথচারী ও অন্য যানবাহন চালকরাও।
দুর্ঘটনার পরিণাম জানা সত্ত্বেও অনেক সচেতন অভিভাবক তাদের ১২-১৭ বছর বয়সী কিশোর সন্তানটিকে কিনে দিচ্ছেন মোটরসাইকেল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত কিশোররা তিন-চারজন করে বন্ধু নিয়ে বাইক চালাচ্ছে সর্বোচ্চ গতিতে। তারা দল বেঁধে বাইক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে। আবার কেউ কেউ মোটরসাইকেল অতিরিক্ত গতিতে চালিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছে টিকটকের জন্য।
সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সচেতন মহল উদ্বিগ্ন।
এছাড়া রাজধানীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থান ও বিনোদনকেন্দ্র হাতিরঝিল সড়কে তরুণ-যুবকদের মোটরসাইকেল রেসে ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত বিশেষ করে রাতে একাধিক মোটরসাইকেল রেস করতে গিয়ে মারাও যাচ্ছে অনেকেই।
আরও পড়ুন: মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে প্রাণ গেলো স্কুলছাত্রের
সুন্দর এই সড়কে কেন প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে- এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে ছয়টি কারণ:
এক. ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো।
দুই. সড়কের বাঁকেও গাড়ির গতি না কমানো।
তিন. রাতে গাড়ি ও মোটরসাইকেল রেস।
চার. উল্টোপথে গাড়ি চালানো।
পাঁচ. রাতের আলো-আঁধারে সড়কে গাড়ি পার্কিং।
ছয়. ছিনতাই চক্র।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ বলছে, রাজধানীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া গতিতে চালানো, রাতে রেসিং করা, সিগন্যাল না মানার প্রবণতা, ফিটনেস না থাকা। অনেকের আবার বয়স কম, তারপরও লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা প্রয়োজন। রাজধানীতে কাগজে-কলমে আছে ৯ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে আছে ৬ শতাংশ। এ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সে কারণে দুর্ঘটনা কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
হেলমেট কিংবা সড়ক আইন কোনোকিছুতেই তোয়াক্কা নেই তাদের-ছবি জাগো নিউজ
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (আরএসএফ) তথ্যানুসারে, গত ২৮ মাসে সারাদেশে (চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) এক হাজার ৬৭৪ শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশ শিশু রাস্তা পারাপারের সময় নিহত মারা যায়। এছাড়া ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিশু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়।
আরও পড়ুন: বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে প্রাণ গেলো কলেজছাত্রের
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আরেকটি তথ্য বলছে, গত তিন বছর ৯ মাসে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার ২৩টি, প্রাণহানি ঘটেছে ২১ হাজার ৯৮৩ জনের। এর মধ্যে ৬ হাজার ৪৭৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৩৩ জন মারা গেছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬৪৮টি, প্রাণহানি হয়েছে ৪ হাজার ৬২২ জনের। এ ছাড়া চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৮৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৯১১ জনের। নিহতদের মধ্যে শিশু-কিশোর রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
আরও পড়ুন: শখের বাইকই কাল হলো কলেজছাত্র রনির
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বছরভিত্তিক হিসাব বলছে, ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে ১ হাজার ১৮৯টি, নিহত হন ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ১ হাজার ৩৮১টি, নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪৬৩ জন। ২০২১ সালে বাইক দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৭৮টি, প্রাণহানি হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের। গত তিন বছরের ব্যবধানে (২০১৯ থেকে ২০২১ সাল) বাইক দুর্ঘটনা ১ হাজার ১৮৯টি থেকে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২ হাজার ৭৮টিতে পৌঁছেছে। মৃত্যু সংখ্যাও ৯৪৫ জন থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ হাজার ২১৪ জনে ঠেকেছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় উঠে এসেছে, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না। ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকায় শিশু-কিশোররা মোটরসাইকেল পেলেই নিয়ম মানছেন না সড়কের। এতে যেমন মোটরসাইকেলে শিশু-কিশোরদের প্রাণ ঝরছে সড়কে, অন্যদিকে পথচারী কিংবা অন্য যানবাহন চালকরাও পড়ছেন বিপদে।
পাড়া-মহল্লা কিংবা মূল সড়কেও দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে রাজনৈতিক মহড়া ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে কিশোর-যুবকরা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অনেক সময় ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন এসব কিশোর-যুবকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় আত্মহনন
মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় রাগ করে গলায় ফাঁস দিয়ে হাসান আলী (১৫) নামে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করে। তার বাবা একজন দরিদ্র মানুষ; মৎস্য আড়তে কাজ করেই তাদের সংসার চলে। নিহত হাসান আলী ছিল সরকারি ভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র।
আরও পড়ুন: ছুটির দিনে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন ৩ বন্ধু
হাসান আলী বাবার কাছ থেকে মোটরসাইকেল কিনতে চায়। দরিদ্র বাবার পক্ষে তা সম্ভব না হওয়ায় অভিমান করে হাসান। ২৪ জানুয়ারি দিনগত রাতে স্কুলছাত্র হাসান আলী বসতঘরের পাশে নির্মাণাধীন ভবনের জানালায় দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়। সকালে তার মা ভবনের পেছনে তাকে ঝুলন্ত দেখতে পেয়ে চিৎকার দেন। এরপর তার বাবা সেখানে গিয়ে ছেলের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান।
চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল নিবন্ধন না করার জন্য নিয়ম কার্যকর করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য- জাগো নিউজ
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ থেকে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদানের সময় সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার বিষয়টি রেজিস্টারিং অথরিটি কর্তৃক নিশ্চিত করতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত কোনো মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাবে না।’
এছাড়া ২০১৯ সালের ১৬ জুন বিআরটিএ থেকে মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, মোটরসাইকেল বিক্রির সময় শিক্ষানবিশ লাইসেন্স আছে কি না, নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ওই বছরের ৪ জুলাই বিআরটিএর সব সার্কেল অফিসে আরেকটি চিঠি দিয়ে বলা হয়, মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশনের সময় চালকের ন্যূনতম লাইসেন্স নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: মোটরসাইকেলের কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হয়: কাদের
তবে রাজধানীর কয়েকটি মোটরসাইকেল বিক্রয় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষানবিশ লাইসেন্স আছে কি না, তাও যাচাই করা হচ্ছে না বিক্রির সময়।
জিপিএ-৫ পাওয়ার সঙ্গে বাড়ছে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার প্রবণতা
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা বহুমুখী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীন্ন হয় মাহফুজুল হক মারুফ নামের এক শিক্ষার্থী। বাবা-মায়ের কাছে বলেছিল, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে কিনে দেবে শখের মোটরসাইকেল। এইচএসসি পরীক্ষার পর ছেলের কথা অনুযায়ী প্রায় ২ লাখ টাকায় কিনে নাজমুন নাহার লিলি দম্পতি কিনে দেয় মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার দেড় মাস পর একটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় টগবগে তরুণ মারুফ। মারুফ ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
জানতে চাইলে মারুফের মা স্কুলশিক্ষিকা নাজমুন নাহার লিলি জাগো নিউজকে বলেন, ছেলের শখের জন্য কিনে দিয়েছিলাম মোটরসাইকেল। কিন্তু সেই মোটরসাইকেলেই যে তার প্রাণ যাবে আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি। ওর শখের মোটরসাইকেলটি সেভাবেই পরে আছে শুধু নেই আমার একমাত্র আদরের সন্তানটি।
সন্তানের আবদারের কথা চিন্তা করে আর কোনো বাবা-মা যেন অল্প বয়সে মোটরসাইকেল কিনে না দেন জানিয়ে তিনি বলেন, ভেবেছিলাম একটি মাত্র ছেলে আমাদের। ওর শখ পূরণে আমাদেরও ভালো লাগবে। তবে এভাবে ও চলে যাবে আগে চিন্তাও করিনি।
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৫ সিসির মোটরসাইকেল অনুমতি
একসময় দেশে মোটরসাইকেলের সিসিসীমা ছিল ১৫৫। পরে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে সিসিসীমা ১৬৫-তে উন্নীত করা হয়। ১৬৫ সিসি সক্ষমতার মোটরসাইকেল আমদানি, উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমোদন রয়েছে। এর বেশি সব ধরনের মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বসীমার বিধান প্রযোজ্য নয়। সিসির জন্য তরুণ অথবা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে মোটরসাইকেল হাঁকানো শিশু-কিশোরদের হাতে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ সিসির মোটরসাইকেলও দেখা যায়, যা রীতিমতো ভীতির উদ্রেক করে।
সমাধানের পথ
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে অভিভাবকদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সন্তানদের আবদারে তাদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছে ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এই মোটরসাইকেল নিয়ে তারা সড়কে উঠলেই বেপরোয়া গতিতে ছুটছে। ট্রাফিক আইন জানে না, জানলেও মানছে না অনেক যুবক। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে, প্রাণ যাচ্ছে তাদের।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেফটি প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী শারমিন রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের লাইসেন্স দেওয়া হয় না। এটিই সবচেয়ে বড় মেসেজ। যেখানে সরকার পারমিশনই দিচ্ছে না, সেখানে আমরা (অভিভাবক) সন্তানদের আবদার রাখতে গিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছি। এতে সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। সন্তানদের মন রক্ষা করতে ও তাদের দাবি মানতে গিয়ে এমন কিছু না করি যাতে সন্তানের বড় ক্ষতি বয়ে আনে। গত কয়েক বছরে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী অনেক শিশু-কিশোর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই এলার্মিং।
আরও পড়ুন: শখের মোটরসাইকেলেই প্রাণ গেলো কলেজছাত্রের
তিনি বলেন, এমনও পরিবার আছে যার একটি মাত্র সন্তান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। আবার পঙ্গুত্ব বরণ করে পুরো পরিবারের মাঝে বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এটি মানসিক ট্রমা। আইনে হয়তো অনেক সময় ব্যাখ্যা দিয়ে অনেক কিছু বলা হয়, এর বাইরেও আমার নিরাপত্তা ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরি। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় টগবগে যুবকরা প্রাণ দিচ্ছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে যুবকরা। মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলোও তাদের বিজ্ঞাপনে গতির প্রতিযোগিতা সামনে আনছে। সড়ক নিরাপত্তা আইনের বাস্তবায়নেও প্রশাসনের গাফিলতি আছে।
তার মন্তব্য, সব মিলিয়ে গতির সঙ্গে ছুটে চলা তেজি যুবকরা অসময়ে সড়কে নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। এতে দেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, অভিভাবকরা সন্তানদের আবদার প্রশ্রয় দিয়ে তাদের হাতে মরণযন্ত্র তুলে দিচ্ছে। এটি পারিবারিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিষয়। সামাজিক ও মূল্যবোধের যেমন ঘাটতি রয়েছে পাশাপাশি সরকারের আইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ঘাটতি রয়েছে। তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে না। অল্প বয়সী ছেলেরা যখন মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য তাদের আটকায় না অর্থাৎ তাদের আইনের আওতায় আনে না।
সড়কে এভাবেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে শিশু-কিশোররা-ছবি জাগো নিউজ
এ দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে দুটি উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ; যেটি সরকার নেবে। আরেকটি সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ। এটি সামাজিক সংগঠন, পরিবার ও সরকার সমন্বিতভাবে নেবে। অর্থাৎ ব্যাপক প্রচারণা তথা ক্যাম্পেইন চালাতে করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশ্লেষক অধ্যাপক শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ঢালাওভাবে মোটরসাইকেল প্রোডাকশনের জন্য দেওয়া সুইসাইডের মতো। বাণিজ্য করার অনেক ক্ষেত্র আছে কিন্তু আগামী প্রজন্মকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়ে দুই চাকার বাহনকে সহজলভ্য করা, রেজিস্ট্রেশন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনা, যারা ইন্ডাস্ট্রি করবে বিজ্ঞানের বিপরীত দিক থেকে তাদের ইন্সেন্টিভাইস করা ঠিক হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট যারা আছে তারা শুধু ইনকামের নামে ও অর্থনীতির নামে জীবনের সঙ্গে কতটুকু ট্রেড-অফ করছেন এটা জানছেন না। অন্যান্য দেশে যেখানে মোটরসাইকেলকে নিরুৎসাহিত করছে তা জেনেও দেশে এই পথটাকে উন্মোচিত করে দেওয়া হয়েছে। সমস্যাটা তৈরি করছি রাষ্ট্রীয়ভাবে।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেল অভিশাপ। এটি তরুণ প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। একটি পরিবারের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। আগামী প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেয়। তরুণদের কাছে ফিল্ড মানেই গতি। আর গতি যে ক্ষতি তা তারা বোঝে না। সরকারকে দুই চাকার যানের প্রডাকশন, রেজিস্ট্রেশন এবং দামে অনেক কৌশলী হতে হবে।
জানতে চাইলে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আইনেই বলা আছে- মোটরসাইকেল চালাতে প্রথমেই থাকতে হবে বৈধ লাইন্সেস। কেউ যদি লাইন্সেস নিয়ে অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করে তাকে আমরা মার্ক করি এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শুধু মোটরসাইকেল নয়, বিভিন্ন বাস, কাভার্ড ভ্যান ও লেগুনার ড্রাইভিং লাইসেন্স অপ্রাপ্ত ও হেলপারদের কাছে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: নিম্নমানের হেলমেটের ছড়াছড়ি
মোটরসাইকেল খেলনা নয় উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, মোটরসাইকেল যে কোনো সময় দুর্ঘটনার কারণ হতেই পারে। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ এক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে। সচেতনতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াও মোটরসাইকেল বিক্রি হচ্ছে। জানতে চাইলে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনো বিক্রয়কেন্দ্রে মোটরসাইকেল বিক্রি করতে পারবে না। যার লাইসেন্সই নেই, যার ১৮ বছর বয়স হয়নি সে মোটরসাইকেল কিনবে কেন?
তিনি বলেন, ১৮ বছর কম বয়সীদের কাছেও লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল বিক্রি না করতে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। শুধু নাবালক নয়, সন্তান সাবালক হলেও যেন তাদের মোটরসাইকেল ব্যবহার থেকে বিরত রাখে। কারণ মোটরসাইকেল অনিরাপদ বাহন। এর মাধ্যমে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে। অভিভাবকরা যেন তাদের সন্তানদের এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন।
টিটি/এসএইচএস/এএসএম