কেটে গেছে ২৮ বছর
পূর্বাচল উপশহরের কাজ শেষ হবে কবে?
#রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জের ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে উপশহর প্রকল্প শুরু করেছিল রাজউক
#২৮ বছরে পাঁচবার নকশা পরিবর্তন এবং সাতবার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি
#২৬ হাজারের মধ্যে মাত্র ২০-৩০টি প্লটে কাজ শুরু হয়েছে
ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমাতে ২৮ বছর আগে একটা উপশহর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। এখনো প্রকল্প এলাকায় খুঁড়িয়ে চলছে সড়ক, সড়কবাতি, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়োনিষ্কাশন সংযোগের কাজ। স্কুল-কলেজ, পার্ক, মাঠ ও হাসপাতালসহ নানা নাগরিক সুবিধাও নিশ্চিত হয়নি। ফলে উপশহর প্রকল্পে প্লট কিনে অনেকেই এখন বিপাকে পড়েছেন।
১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকার বিকল্প জনবসতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প শুরু করে রাজউক। অথচ দীর্ঘ ২৮ বছরেও সেখানে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে, এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় প্লট মালিকরা । এ অবস্থায় যারা ওই প্রকল্পে প্লট কিনেছিলেন তাদের কেউ কেউ এখন তা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
পূর্বাচল প্লট মালিকদের অভিযোগ, এ উপশহর প্রকল্প নিয়ে রাজউক তামাশা করছে। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এরমধ্যে পাঁচবার নকশা পরিবর্তন আর সাতবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু প্রকল্পের কাজে যে ধীরগতি তাতে ওই সময়ের মধ্যেও তা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারবে না সংস্থাটি।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্প এলাকার ৮০ শতাংশ সড়কের কাজ শেষ। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়োনিষ্কাশন কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। নির্ধারিত সময়ে বাকি কাজ শেষ হবে । এখন প্লট মালিকরা চাইলে ভবন নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেন। নকশা অনুমোদনসহ অন্যান্য সেবা চলমান।
রাজউক সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া এ উপশহর প্রকল্পে ৩০টি সেক্টরে ২৬ হাজার আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজউকের কাছ থেকে মাত্র ২৮৫টি প্লটের মালিক ভবন তৈরির নকশার অনুমোদন নিয়েছেন। এরমধ্যে ২৫-৩০ জন ভবন নির্মাণ করেছেন। বাকিরা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় বাড়ি নির্মাণ করতে সাহস পাচ্ছেন না। তবে পূর্বাচল প্রকল্পে ১০০ ফুট খাল খনন, ব্রিজ নির্মাণ, পানি সরবরাহ লাইন, সড়ক ও নর্দমা নির্মাণকাজ চলছে। সংস্থাটি বলছে, প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।
রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে ৩০০ ফিট সড়ক দিয়ে রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতু যেতে হাতের দুপাশে এলাকাটি পূর্বাচল উপশহর। এ রুটে চলার পথে বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা। প্লটগুলোতে বড় বড় আগাছা জন্মেছে। এরই ফাঁকে মাথাচাড়া দিচ্ছে দু-একটি ভবন। দিনের বেলায়ই পুরো প্রকল্প এলাকা নির্জন । সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার, গা ছমছম ভুতুড়ে পরিবেশ। ভেতরের এলাকাগুলোতে মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। ৩০০ ফিট সড়ক ছাড়া প্রকল্প এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে তেমন কোথায়ও কাউকে কাজ করতে দেখা যায়নি। তবে সড়কের পাশে থাকা প্লটে অনেকেই শাক-সবজি চাষ করছেন। আর নীলা মার্কেট এলাকায় বালু নদীর পাড়ে শতাধিক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে ঘুরতে যান দর্শনার্থীরা।
পূর্বাচল প্রকল্পের ৪ নম্বর সেক্টরে একটি প্লট কিনেছিলেন মালিবাগের প্রবীণ বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিন বছর আগে তিনি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে অবসরে যান। আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, রাজউক জরুরি সেবাগুলো চালু না করায় প্লটে ভবন নির্মাণ করতে পারছি না। এখন প্লটটিতে আগাছা জন্মে জঙ্গল হয়ে আছে। কবে নিজ বাড়িতে বাস করবো, তা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
১৮ নম্বর সেক্টরে চার কাঠার একটি প্লটের মালিক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সরকারি চাকরিজীবী। তার কথায়, প্লটটি তিনি কিনেছিলেন স্ত্রীর নামে। কিন্তু রাজউক যে গতিতে কাজ করছে, ২০২৪ সালেও পুরো কাজ শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব কাজ শেষ হলেও এই এলাকায় বাসাবাড়ি নির্মাণ করে বাস উপযোগী পরিবেশ করতে আরও অন্তত ১০ বছর সময় লেগে যাবে।
নীলা মার্কেট বরাবর ৩০০ ফিট রাস্তার উত্তর পাশে একটি সাততলা নতুন ভবন। দুই বছর আগে এ ভবনটি তৈরি করেন বাড়ির মালিক শাহজাহান। তিনি এখন উত্তরায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আলাপকালে শাহজাহান বলেন, তার বাড়িতে প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট আছে। এগুলো ৮ হাজার টাকা করে ভাড়া দিয়েছেন। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকায় অনেকেই বাসাভাড়া নিতে চান না। এখন নিজ নলকূপ থেকেই পানির চাহিদা মিটছে। এখানে সব সুবিধা নিশ্চিত হলে এই ফ্ল্যাটগুলোই ১৫-১৬ হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়া যাবে।
গত ১ অক্টোবর পূর্বাচল প্রকল্পের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। তখন তিনি প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী ওয়াছি উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ঢিমেতালে কাজ করে প্রকল্প আর দীর্ঘায়িত করা চলবে না। যে প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের কাজ করছে, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। অন্যথায় তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজউক চেয়ারম্যানকে এমন নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
পূর্বাচল প্রকল্প সূত্র জানায়, পূর্বাচল প্রকল্পে পানি সরবরাহ সেবা দিতে রাজউক স্বতন্ত্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রাথমিকভাবে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে ভূউপরিস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এরই মধ্যে পূর্বাচল প্রকল্পে ৪০ কিলোমিটার পানি সরবরাহ সেবার পাইপ লাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৩২০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২৯০ কিলোমিটার তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন ও পয়োবর্জ্য নেওয়ার কাজও চলছে।
এদিকে পূর্বাচলে সবার আগে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, নাগরিক সেবাগুলো যত দ্রুত নিশ্চিত করা যাবে, তত দ্রুতই মানুষ সেখানে বসতি গড়ে তুলতে পারবেন। এখন সেখানে কোনো সুবিধাই নেই । সেখানে ভবন তৈরি করতে যে পরিমাণ পানি লাগবে, তা-ও সরবরাহ করার জায়গা নেই। তাহলে মানুষ কীভাবে সেখানে যাবে।
এ বিষয়ে পূর্বাচল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, পূর্বাচলে আবাসিক প্লটের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বাজারের জন্যও পৃথক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো নির্মাণ না করায় সেখানে বসতি গড়তে বা ভবন তৈরিতে প্লট মালিকদের আগ্রহ কম। তাই এ সুবিধাগুলো আগে নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক সভা করা হয়েছে। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো নির্মাণে সম্মতি দিয়েছেন।
এমএমএ/এমকেআর/এসএইচএস/জিকেএস