বড় হামলার আশঙ্কা
আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম
দেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। ২০১৭ সালে সংগঠনটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপরও গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী জঙ্গি নেটওয়ার্ক। আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে বলা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় জঙ্গি কার্যক্রম। আর এ ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে ঘটিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। আল-কায়েদা থেকে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পেয়ে তারা বড় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে কি না তা যাচাই করছেন গোয়েন্দারা।
আনসার আল ইসলামকে আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী বলা হয়। আনসার আল ইসলাম ভারতীয় উপ-মহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএসের (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) মতাদর্শে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক হামলায় সরাসরি অংশ নেয়।
বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনের সহিংস কর্মকাণ্ড না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হওয়ার কাজ করছে। তারা যদি আবারও সহিংস কর্মকাণ্ডে ফিরে আসে তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সম্প্রতি ঢাকার আদালত থেকে দিনে-দুপুরে জঙ্গি ছিনতাই করে তারা জানান দিতে চাচ্ছে সামনে বড় কোনো ঘটনা ঘটাবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে যতগুলো জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী আনসার আল ইসলাম। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আদালত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য সফল হয়েছে। এ ঘটনায় সংগঠনটির টপ টু বটম এখন উজ্জীবিত। এই উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে সংগঠনটি বড় কিছু করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার কোনো নির্দেশনা আনসার আল ইসলাম পেয়েছে কি না সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
জঙ্গি দমনে কাজে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এমন বেশ কয়েকটি বাহিনীর ইউনিটের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার বাংলাদেশি শাখা (একিউআইএস) বলা হয়। সম্প্রতি আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমের ধরন দেখে গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন আল-কায়েদা থেকে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পেয়ে মাঠে নেমেছে তারা। বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে পুরোনো ও বিশ্বাসযোগ্য সদস্যদের যে কোনো মূল্যে কাছে পেতে চাচ্ছে সংগঠনটি। তবে ঠিক কী নির্দেশনা আনসার আল ইসলামের কাছে এসেছে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
কার্যক্রম চলে ‘কাট আউট সিস্টেমে’
আনসার আল ইসলাম এমনভাবে তাদের কাজ করে যে দাওয়া শাখার সদস্যরা একে অপরের পরিচয় জানতে পারেন না। এক গ্রুপের কোনো সদস্যই (মামুর) অন্য গ্রুপের সদস্য কারা, তারা কী কাজ করছেন- এর কোনো কিছুই জানতে পারেন না। তাদের সব কাজই চলে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। তাদের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে জানেন কেবল নেতা পর্যায়ের কয়েকজন। অর্থাৎ, কাট আউট সিস্টেম হলো- একটি গ্রুপে চার-পাঁচজন সদস্য থাকলে কেউ তাদের আসল পরিচয়, নাম কিংবা অন্য কোনো তথ্য জানে না। তাদের একটি টার্গেট থাকে সেই টার্গেট বাস্তবায়ন করাই তাদের কাজ।
জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কোনো অপারেশন, হামলার ঘটনার পর জড়িত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও সংগঠনটির অন্য পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত কাট আউট পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনার কারণেই তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বড় হামলা কিংবা টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনার আশঙ্কা
সিটিটিসি সূত্র বলছে, দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে নিজেদের পুরোনো ও প্রশিক্ষিত সদস্যদের একত্রিত করে বড় কোনো জঙ্গি কার্যক্রম করার জন্য চেষ্টা করে আসছে সংগঠনটি। নিজেদের সদস্যদের ছিনিয়ে নেওয়ার এই পরিকল্পনা হয় আরও কয়েক মাস আগে। সে চেষ্টা সফল হওয়ায় আদর্শিক ও মানসিকভাবে চাঙা রয়েছে আনসার আল ইসলাম। বড় কোনো জঙ্গি কার্যক্রম করার মতো শক্তি ও সদস্য এরই মধ্যে সংগঠনটি সংগ্রহ করে ফেলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, আনসার আল ইসলাম আবারও সংগঠিত হওয়ার ঘটনা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের ঘটনা প্রমাণ করে তারা এখন যে কোনো কাজ করতে পারে। আমাদের আশঙ্কা, আদালত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার সফলতা কাজে লাগিয়ে তারা এখন অপারেশন লেভেলের কিছু করতে পারে বা করার পরিকল্পনা করবে। অপারেশন লেভেলের কার্যক্রমের মধ্যে তারা হয়তো বড় কোনো জঙ্গি কার্যক্রম, হামলা কিংবা টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনা করতে পারে।
টার্গেট হতে পারে নির্বাচনকালীন বছর
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে জঙ্গিরা তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করে এবং কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো মনে করছে, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি ব্যস্ত থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর ওই সুযোগটাই বেছে নিতে চায় জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে তরুণদের ‘মগজধোলাই’ করছেন জঙ্গি নেতারা। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘আনসার আল ইসলাম’ ও নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার)।
দেশের বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে আনসার আল ইসলাম
আনসার আল ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত দেশে মজবুত না হওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো হচ্ছে।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে জানা যায়, আনসার আল ইসলাম দেশের সমমনা ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা তুলে ফান্ড গঠন করছে। বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের টাকা সংগ্রহ করে উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছে জঙ্গিরা। সম্প্রতি দেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক এবং অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে অর্থ এসেছে বাংলাদেশে। সাংগঠনিক ও অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশের বাইরে ও দেশের অভ্যন্তরীণ সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থায়ন করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় হুমকি মেজর জিয়া
আবারও সামনে এসেছে বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার নাম। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বা মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া। ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার দুই জঙ্গি এমন তথ্য দিয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ২০১২ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন মেজর জিয়া। এই অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকায় দুই সেনা কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও পালিয়ে যান জিয়া। এরপর তিনি যুক্ত হন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে। বহিষ্কৃত জিয়ার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। আনসার আল ইসলামের অধিকাংশ নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, প্রায় এক দশকে তারা অন্তত চারবার জিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় তার অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তবে তাকে গ্রেফতারে বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যান তিনি।
মেজর জিয়া দেশেই আছেন, নাকি দেশের বাইরে পালিয়েছেন, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত পুলিশের একাধিক ইউনিটের দায়িত্বশীলরা। তবে তাকে গ্রেফতারে চেষ্টা কখনই থেমে ছিল না এবং সামনের সময়ও চলমান থাকবে বলে জানান তারা।
সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, পলাতক জঙ্গিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাকারী মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফিকে (২৪) আমরা গ্রেফতার করেছি। তিনি রিমান্ডে রয়েছেন। তার কাছ থেকে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি নির্মূল করা কঠিন, তবে আমরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।
গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সের (জিটিআই) তথ্যমতে, জঙ্গিবাদ দমনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০। সবার প্রথমে আফগানিস্তান। পাকিস্তান রয়েছে ১০-এ, ভারত ১২-তে, যুক্তরাষ্ট্র ২৮-এ ও যুক্তরাজ্য ৩১-এ। যোগ করেন সিটিটিসি প্রধান।
দেশে আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম এবং বড় হামলার পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। তবে এখনো কয়েকজন পলাতক। তাদের গ্রেফতার করা আমাদের মূল টার্গেট। আনসার আল ইসলাম কাট আউট পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং তারা এনক্রিপ্টেড অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের মধ্যে যোগযোগ রক্ষা করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মেজর জিয়া আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৌশলে আড়ালে-আবডালে অবস্থান করছেন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব আধুনিক প্রযুক্তি বা কৌশল ব্যবহার করে, জঙ্গিরাও সেই জিনিসগুলো ধারণ করে (সেগুলো ব্যবহার করে)। এসব ক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে। তবে আমরা তাকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, জঙ্গি দমনে পুলিশের বিশেষ দুটি ইউনিট কাজ করে- সিটিটিসি ও এটিউ। এছাড়া রয়েছে র্যাব। আমি মনে করি জঙ্গি দমনে আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে। আমরা জঙ্গিদের সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। তবে যে কোনো সময়ের জন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
টিটি/এএসএ/জিকেএস