ফারদিন হত্যা
রাস্তামুখী সিসি ক্যামেরা লাগানো মানা, বন্ধ চনপাড়ার অধিকাংশ দোকান
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। রূপগঞ্জের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক এলাকা। পরিচিত ‘চনপাড়া বস্তি’ নামে। যে কোনো ধরনের মাদক সহজলভ্য এখানকার অলি-গলিতে। চলে দেশি-বিদেশি অস্ত্র বেচাকেনা। দাগি আসামিদের নিশ্চিন্তে পালিয়ে থাকার ‘সেফ হোম’। রাজনৈতিক সভা, মিছিলে লোক সাপ্লাই, মধ্যম থেকে নিম্নসারির রাজনৈতিক নেতাদের ভাগবাটোয়ারা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন এখানকার সিন্ডিকেট সদস্যরা। দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে নিতে হয় এলাকার ‘নিয়ন্ত্রকদের’ অনুমতি। এই এলাকায়ই মিলেছে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের মরদেহ। এরপর থেকে চনপাড়ার অধিকাংশ দোকান বন্ধ।
রোববার (১৩ নভেম্বর) সরেজমিনে চনপাড়া ঘুরে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।
চনপাড়া ঘুরে আরও জানা যায়, প্রায় লাখখানেক লোকের বসবাস এখানে। সড়কপথে এই এলাকায় যেতে হলে রাজধানীর ডেমরা হয়ে বালু নদের ওপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়। স্থলপথে এটিই চনপাড়ায় প্রবেশের একমাত্র রাস্তা। ভৌগোলিকভাবে জায়গাটি দুর্গম হওয়ায় এখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি বহাল। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মাঝে মধ্যেই হয় মারামারি-সংঘর্ষ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের সবশেষ অবস্থান চনপাড়ায় ছিল বলে নিশ্চিত হওয়ার পর ফের আলোচনায় আসে এ জনপদটি। ফারদিন হত্যাকাণ্ড ও গত বৃহস্পতিবার র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সিটি শাহীন নিহত হওয়ার পর থেকে চনপাড়ার প্রতিটি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। কিছু দোকান খোলা থাকলেও খুব বেশি সময় তারা খোলা রাখছেন না। এছাড়া ফারদিন হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও মুখ খুলছেন না কেউ।
প্রশ্ন উঠেছে ফারদিন চনপাড়ায় কীভাবে কার সঙ্গে গিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চনপাড়ায় একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তায় কোনো দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে দেন না মাদক কারবারিরা। তারা মনে করেন, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগালে অপরাধীদের সব ছবি/ভিডিও প্রকাশ হবে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে পৌঁছে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘মাদক সংশ্লিষ্টতা’ নাকি রাজনৈতিক বিদ্বেষ, কোনটা কাল হলো ফারদিনের?
এ কারণে ফারদিন চনপাড়ায় কীভাবে গেলেন তা বাজারের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ সব সিসিটিভি দোকানের ভেতরে। বাইরে যে দু-একটি রয়েছে সেগুলো নষ্ট।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার রাতে ফারদিন কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকার জনসন রোড এবং রূপগঞ্জ ও ডেমরাসংলগ্ন চনপাড়া এলাকায় অবস্থান করছিলেন। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে তিনি ছিলেন চনপাড়া এলাকায়।
রাত ২টা থেকে ভোর পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টার ফুটেজ একটি দোকানে দেখতে গেলে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক জানতে পারেন, রাস্তার সামনে দোকানের যে ক্যামেরা সেটি নষ্ট। ভেতরে বাকি তিনটি ক্যামেরা সচল। তবে তাতে রাস্তা বোঝা যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দোকানি জাগো নিউজকে বলেন, এক বছর আগে নিরাপত্তার স্বার্থে দোকানের সামনে এদিক-ওদিক করে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরাসহ মোট পাঁচটি ক্যামেরা লাগাই। লাগানোর দুদিন পর জানতে পেরে সিটি শাহীনের লোকজন রাস্তার সামনের ক্যামেরাটি ভেঙে ফেলে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় খুন হয়ে থাকতে পারেন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন
তিনি বলেন, দিন-রাত এখানে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ হয়। এজন্য এখানকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একটি সিন্ডিকেট সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা দেখে, কোন কোন দোকানে ক্যামেরা লাগানো এবং রাস্তার দিকে কোনো ক্যামেরা আছে কি না।
নিজের ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার স্বার্থে আরেক দোকানদার বলেন, বজলুর রহমান ওরফে বজলু নামে একজন প্রভাবশালী নেতা থাকেন চনপাড়ায়। ক্যামেরা লাগাতে হলে লাগে তার অনুমতি। এছাড়া ক্যামেরাগুলো কোথায় কোথায় লাগানো হবে দেওয়া লাগে তারও হিসাব।
কথিত রয়েছে, চনপাড়া মাদক সিন্ডিকেটের হোতা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করে। এর আগেও চনপাড়া বস্তিতে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব ঘটনার কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ পাওয়া যায়নি।
এলাকা ঘুরে জানা যায়, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকা থমথমে। সিটি শাহীন বাহিনীর চিহ্নিত সদস্যরা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়েছেন। পালিয়েছেন মাদক সিন্ডিকেটের হোতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান ওরফে বজলুসহ তার তিন ভাই ও মেয়ে-জামাই। এছাড়াও পুরুষদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া এক নারী মনুও পলাতক।
চনপাড়া বস্তিতে এখন বাইরের মানুষের আনাগোনাও কম। তবে থেমে নেই মাদক বেচা-কেনা। আগে যেখানে প্রকাশ্যে মহল্লার অলি-গলিতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করা হতো, বন্দুকযুদ্ধে সিটি শাহীনের মৃত্যুর পর কৌশল বদলেছে বিক্রেতারা। গোপনে চলছে বিক্রি।
আরও পড়ুন: বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যা, ‘খুনি টেকনোলজিক্যালি স্মার্ট’
চনপাড়া বস্তিতে দোকান আছে দেড় শতাধিক। ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার ও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সিটি শাহীন নিহত হওয়ার পর থেকে চনপাড়ায় খোলা রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান। যেসব দোকান খোলা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার বেশিরভাগ দোকানি মাদক কারবারির সঙ্গে অথবা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে মামলাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে তারা দোকান বন্ধ রেখে পালিয়ে গেছেন অন্যত্র।
জানা যায়, নিহত সিটি শাহীনের একটি বড় অপরাধ বাহিনী রয়েছে এলাকায়। তিনি ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। হামলা-নির্যাতনের ভয়ে শাহীন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস নেই কারও। প্রায় পঞ্চাশাধিক নারী, পুরুষ ও তরুণের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিকাংশই জাগো নিউজকে জানান, চনপাড়ায় হয় না এমন কোনো কিছু নেই। চনপাড়ায় রাতকে দিন আবার দিনকে রাত বানিয়ে দেওয়া যায়। এখানে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের নিয়ন্ত্রণে পুরো বস্তিবাসী। বস্তিতে কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলেও লাগে প্রভাবশালীদের অনুমতি। তাদের কথা না শুনলে চলে নির্যাতন ও চাঁদাবাজি।
জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, ফারদিনের গতিবিধি ও মোবাইলের অবস্থান পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে চনপাড়া বাজার এলাকায় নিখোঁজ হওয়ার দিন ভোরের দিকে কোনো ঘটনা ঘটেছিল। তবে কী ঘটেছিল বিষয়টি উন্মোচনে র্যাব কাজ করে যাচ্ছে।
সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, সরকারিভাবে ক্যামেরা লাগানোর জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই। তবে আমরা নাগরিকদের অনুরোধ করি নিরাপত্তার স্বার্থে যেন তারা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগান।
চানপাড়া দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রোববার (১৩ নভেম্বর) পর্যন্ত ফারদিন হত্যার ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু নতুন বিষয় সামনে আসায় সেগুলো নিয়ে ‘ক্লু’ উদ্ঘাটনে কাজ চলছে। ফলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রহস্য উন্মোচনে সময় লাগছে।
এদিকে, মাদকের সঙ্গে ফারদিনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। তবে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে তার পরিবারের দাবি, ফারদিন মাদকের সঙ্গে কখনোই সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। ফারদিন ধনীর দুলাল নন, ফলে তাকে স্ট্রাগল করে বড় হতে হয়েছে। তার বাবার উপার্জন খুব বেশি নয়। এ অবস্থায় নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাতে কোচিং ও টিউশনি করতেন ফারদিন। সেই টাকা থেকে ছোট দুই ভাইয়েরও খরচ দিতেন তিনি।
আরও পড়ুন: বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যা, বান্ধবী বুশরা গ্রেফতার
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ গত ৫ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ওইদিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।
এরপরই তার দুই বন্ধু বুশরা ও শীর্ষ সংশপ্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর গত বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) রামপুরার বাসা থেকে বুশরাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওইদিনই ফারদিন হত্যা মামলায় তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। বুশরা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বুধবার (৯ নভেম্বর) দিনগত রাতে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা সাংবাদিক নূর উদ্দিন রানা।
আরও পড়ুন: বুশরার সঙ্গে ধানমন্ডি-ঢাবি ঘুরে রামপুরা থেকে নিখোঁজ হন ফারদিন
ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গত ৮ নভেম্বর ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ বলেছিলেন, ময়নাতদন্তে আমরা দেখতে পেয়েছি, ফারদিনের মাথায় এবং বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সেই আঘাত কোনো ধারালো অস্ত্রের নয়। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশের চাহিদা ও অধিকতর তথ্যের জন্য তথ্য-উপাত্ত ও আলামত মহাখালী ভিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে ফারদিনকে কীভাবে খুন করা হয়েছে।
ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার নয়ামাটিতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফারদিন ছিলেন সবার বড়। তার মেজ ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।
রহস্য উন্মোচনে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, এলিট ফোর্স র্যাব, সিআইডিসহ একাধিক ইউনিট কাজ করছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকার শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ফারদিনের সবশেষ অবস্থান শনাক্ত ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেও কাজ করছে পুলিশ।
তবে এরই মধ্যে পুলিশ জানিয়েছে, ফারদিনের হত্যাকারী টেকনোলজিক্যালি খুবই স্মার্ট।
টিটি/এএসএ/কেএসআর