তথ্য-ছবির অপব্যবহারের শঙ্কা
ল্যাপটপ-মোবাইল হারিয়ে বিপাকে ভুক্তভোগীরা, উদ্ধারে ধীরগতি
অফিসিয়াল, ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত- প্রতিদিনের নানা কাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও ট্যাব। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। এসব প্রযুক্তিপণ্য জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি করেছে দ্রুতগামীও। প্রয়োজনে মুহূর্তের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে ফেলা যায় এসবের সাহায্যে। এ কারণে এসব পণ্যের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাব হারালে বা ছিনতাইয়ের কবলে পড়লে পড়তে হয় বিপদে। প্রতিদিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটাসহ ব্যক্তিগত তথ্য, গোপন নথি হারিয়ে শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে থাকতে হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু হারালে বা চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই আইনের আশ্রয় নেওয়া উচিত। এছাড়া এসব চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ডিএমপিতে ২০২০ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৭৬টি। গাড়ি, তার, গরু এসব চুরি বাদে অন্যান্য ৮৭৪টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি, চুরির ঘটনা ৯৮৬টি। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭১টি। চুরির ঘটনা ঘটেছে ৫৯৩টি। রাজধানীতে এসব চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই মোবাইল ও ল্যাপটপ।
মোবাইল, ল্যাপটপ চুরি-ছিনতাই ও হারানোর ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। জানা গেছে, গুলশান মডেল থানায় প্রতি মাসে গড়ে মোবাইল, ল্যাপটপ চুরি-ছিনতাই ও হারানোর ঘটনায় ১০০-১২০টি জিডি হয়। জিডির বিপরীতে গুলশান থানায় কেবল গত আগস্টে উদ্ধার হয়েছে ৪৫টি মোবাইল।
মোবাইল হারিয়ে তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে চিন্তিত থাকেন ভুক্তভোগীরা
রাজধানীসহ সারাদেশে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, এনআইডি চুরি ও ছিনতাই বা হারিয়ে যাওয়ার এমন ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিনই তা ঘটছে। এতে বিপাকে পড়ার পাশাপাশি শঙ্কা ও ভয়ে থাকেন এসব প্রয়োজনীয় জিনিস হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিরা।
গত ২৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ লিমা স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আনতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) যান। মানুষের ভিড় থাকায় রিপোর্ট পেতে তাকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। ভিড়ের মধ্যে হাতে থাকা মোবাইল ফোন ব্যাগে রাখেন। রিপোর্ট নেওয়ার পর ব্যাগে হাত দিয়ে দেখেন মোবাইলটি নেই। চুরি হয়ে যাওয়া মোবাইলটি খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে শাহবাগ থানায় জিডি করেন। মোবাইলে থাকা নানা ডকুমেন্ট ও তথ্য নিয়ে বেশি চিন্তিত না হলেও লিমার বেশি চিন্তা মোবাইলে রাখা ছবি নিয়ে। ব্যক্তিগত ও বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি রয়েছে ফোনে। ছবিগুলোর কোনো অপব্যবহার হয় কি না তা নিয়েই বেশি ভয় এই তরুণীর।
গত ১৯ এপ্রিল লুৎফর রহমান রাজু নামের আরেক ব্যক্তি তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে রিকশাযোগে শাহবাগ মোড় থেকে বাংলামোটরের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ রিকশার পিছন থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে আসা দুই ছিনতাইকারী তার স্ত্রীর হাতে থাকা পার্স নিয়ে চলে যায়। পার্সে মোবাইল, মানিব্যাগ, এটিএম কার্ড, এনআইডি কার্ড ছিল। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করলেও এখনো তা ফিরে পাননি। এসব হারিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছেন তিনি।
২০১৬ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাইড ব্যাগে থাকা পার্স ও মোবাইল চুরি হয় খুজিস্তা রুবাইয়াতের। এতে কিছুটা ভীত হয়েই মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন তিনি। জানতে চাইলে জাগো নিউজকে বলেন, আমার চুরি যাওয়া মোবাইল নিয়ে কোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে আমি বিপদে পড়ে যেতে পারি। তাই শঙ্কা নিয়েই থানায় জিডি করে রেখেছি। এখনো সেই মোবাইল পাওয়া যায়নি। আর পাবো বলেও মনে হয় না।
আরও পড়ুন: বিজয় সরণি থেকে পরিকল্পনামন্ত্রীর মোবাইল ফোন ছিনতাই
মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, এনআইডি চুরি ও ছিনতাই বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জিডি করা ব্যক্তিদের অভিযোগ, কয়েকদিন যোগাযোগ রাখার পর থানা থেকে তেমন কোনো সাড়া মেলে না। হারিয়ে যাওয়া মোবাইল, ল্যাপটপ, এনআইডিও দ্রুত উদ্ধার হয় না। এতে বিরক্ত হয়ে আর যোগাযোগই করেন না তারা। তবে কোনো কোনো থানায় সেই তৎপরতা কিছুটা বেশি থাকে। ফলে অন্যান্য থানার তুলনায় সেখানে জিডিও হয় বেশি।
রাজধানীর বিভিন্ন থানার মধ্যে হারানো পণ্য উদ্ধারের সফলতায় এগিয়ে গুলশান মডেল থানা। এই থানার এএসআই আব্দুল কাদির প্রতি মাসে তাদের কাছে আসা মোবাইল হারানোর অভিযোগের মধ্যে গড়ে ৫০-৬০ শতাংশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
এএসআই আব্দুল কাদির জাগো নিউজকে বলেন, আমার মোবাইলটিও হারিয়েছি, এখনো পাইনি। মোবাইল হারানোর কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পারি। সেই উপলব্ধি থেকেই মোবাইল উদ্ধারের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। অনেক ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হয়। গত মাসেও ৪৫টি মোবাইল উদ্ধার করেছি। তবে খোয়া যাওয়া মোবাইল চালু না করলে তা পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
আরও পড়ুন: স্মার্টফোন হারিয়ে গেলে দ্রুত যা করবেন
মোবাইল-ল্যাপটপ হারানোর এমন চিত্র শুধু রাজধানীতেই নয়, রাজধানীর বাইরেও বহু ঘটনার খবর পাওয়া যায়। চলতি বছরের ১৩ মার্চ ঢাকা থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন মো. নাসিব ইসলাম অভি। রাতে দীর্ঘ পথযাত্রায় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ভোরে বগুড়ার সান্তাহারে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মোবাইল নেই। পরে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থানায় জিডি করলেও এখনো সন্ধান মেলেনি।
মাহমুদ নামের অন্য এক ব্যক্তি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নরসিংদীর মেথিকান্দা স্টেশন থেকে ঢাকায় আসার পথে ট্রেনে ওঠার সময় পকেট থেকে চুরি হয় তার মোবাইল। ব্যক্তিগত তথ্য, ছবিসহ চাকরির প্রস্তুতির যাবতীয় তথ্য হারিয়ে অনেকটাই বিপাকে পড়েন তিনি।
তিনি জানান, করোনাকালীন পরিস্থিতির মধ্যে তখন হারানো মোবাইল উদ্ধারে জিডিও করেননি। তবে এখন ব্যক্তিগত তথ্যের কোনো অপব্যবহার হয় কি না তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় আছেন বলে জানান।
গত বছর ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে ভৈরব রেলস্টেশনে নামেন মসিউর রহমান সূর্য। সেখান থেকে অটোতে ভৈরব বাসস্ট্যান্ড নেমে ভাড়া দিয়ে রাস্তা পার হয়ে দেখেন পকেটে মানিব্যাগ নেই তার। মানিব্যাগে থাকা ৪ হাজার টাকা, এনআইডি কার্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ, ছবি নিয়ে যায়। এনআইডি কার্ডের জন্য জরিমানা দিয়ে আবেদন করে এখনো পাননি বলে জাগো নিউজকে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: যেভাবে উদ্ধার হলো পরিকল্পনামন্ত্রীর আইফোন
শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এ ধরনের চুরি-ছিনতাইয়ের সম্মুখীন হন মন্ত্রী থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সরকারি কর্মকর্তারাও। গত ২১ মে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিজ দপ্তর থেকে বেইলি রোডের বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর বিজয় সরণি ট্রাফিক সিগন্যালে সন্ধ্যায় গাড়ির জানালা খুলে ফোনে কথা বলার সময় হাত থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায় এক ছিনতাইকারী। যদিও প্রায় দুই মাস পর সন্ধান মেলে তার মোবাইলের।
রাজধানীতে সক্রিয় ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল চুরির সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র
গত ২ আগস্ট সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ সরকারি সফরে খুলনার কয়রায় গেলে তার সফরসঙ্গী হন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আল-আমিন। প্রতিমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে সেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়। এর মধ্যেই চুরি হয়ে যায় আল-আমিনের মোবাইলটি। চুরি হয়ে যাওয়া মোবাইলে গুরুত্বপূর্ণ নথি থাকলেও এখনো পাননি তিনি।
গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় গাড়ির জানালা খুলে হাতে মোবাইল নিয়ে কাজ করছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মুহাম্মদ (জিএম) কাদের। এসময় হঠাৎ এক ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোনটি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে যান। কয়েকদিন পার হলেও তা উদ্ধার করা যায়নি। তবে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: গাড়ি থেকে ছোঁ মেরে জিএম কাদেরের মোবাইলফোন ছিনতাই
মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি, ছিনতাই ও হারিয়ে গেলে নতুন করে সেটি কেনার সামর্থ্য থাকলেও প্রথমেই নিকটস্থ থানায় জিডি করা ও যথাযথ আইনি তৎপরতা থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, মোবাইল বা কোনো ডিভাইস যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য প্রথমে নিজের সচেতনতা জরুরি। তবে যখনই চুরি, ছিনতাই বা হারিয়ে যায় তখন সেটা পুলিশকে না জানালে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই প্রথম কাজ হলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা। তারপরই পুলিশের কাজ শুরু হয়, তার আগে আমাদের কিছু করার নেই। আর অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধীকে যখন ধরা হয়, তখন তাদের কাছে যেসব মোবাইল পাওয়া যায় সেগুলো যাচাই করে যদি দেখি তাদের নয়, তখন মালিককে হস্তান্তর করি। এটা দিয়ে কেউ যেন অপরাধমূলক কাজ করতে না পারে, তার একটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (ব্যাকআপ) হিসেবে এই কাজ করে।
জিডি করার পর দীর্ঘদিন পার হলেও মোবাইল, ল্যাপটপ বা অন্য কোনো ডিভাইস খুঁজে না পাওয়ার বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এটা একটা প্রযুক্তি। চুরি-ছিনতাইয়ের পর মোবাইল কিংবা ওই ডিভাইসটি যদি না খোলা হয়, তাহলে আমরা যতই খোঁজাখুঁজি করি এর অবস্থান পাবো না। এক বছর যদি ব্যাটারি খুলে রাখে, এই এক বছরই সেটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে একটা মোবাইলকে খুব বেশি ট্র্যাক করা সম্ভব হয় নয়। কারণ প্রতি বছর আমাদের কাছে হাজার হাজার অভিযোগ আসে। তবে অভিযোগকারী যত বেশি যোগাযোগ রাখবে, তত ভালো।
এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, মোবাইল বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি, ছিনতাই বা হারিয়ে গেলে নতুন করে সেটি কেনার সামর্থ্য থাকলেও প্রথমেই নিকটস্থ থানায় জিডি করা প্রয়োজন। হারিয়ে যাওয়া জিনিসটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এছাড়া অপরাধের পেছনে কারা জড়িত তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
আরএসএম/ইএ/এসএইচএস/আরএডি