ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে খোয়া যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা
দেশে বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেন। ক্যাশলেস হওয়ায় ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে এ মাধ্যম। একই সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণাও। প্রতারকচক্র প্রতিনিয়ত কৌশল বদলে ফাঁদে ফেলে লুটে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। টাকা খুইয়ে পথে বসছে অনেক মানুষ। ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং বেশ এগিয়ে। কার্ডেও লেনদেন বেড়েছে আগের চেয়ে। তবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংকে বেছে নিচ্ছে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। চলতি বছর সাইবার অপরাধে যে মামলা হয়েছে তার প্রায় ৩২ শতাংশ প্রতারণার।
পুলিশ বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নজরদারি থাকলেও ডিজিটাল প্রতারণার এসব মাধ্যম ব্যক্তিগত হওয়ায় পুলিশের নজরদারির সুযোগ খুবই কম। এই সুযোগ না থাকায় এই মাধ্যমগুলোতে হয়তো প্রতারণা হচ্ছে।
চলতি বছরের ১৯ আগস্ট সকালে জামাল হোসেনের বিকাশ নম্বরে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করলে অন্যপ্রান্ত থেকে বলা হয়, আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। বিকাশ অফিস থেকে ফোন দিয়ে অ্যাকাউন্ট ঠিক করে দেবে। তারপর বিকাশ অফিসের কর্মীর পরিচয়ে তার নম্বরে কল আসে। অন্য একটি নম্বরে তথ্য দিতে বললে মেসেজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্টের তথ্য দেন তিনি। ভেরিফিকেশন কোড চাইলে তাও বলে দেন জামাল। এরপর তার বিকাশ থেকে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা তুলে নেন প্রতারক।
এ বিষয়ে জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমার বড় বোন ক্যানসারের রোগী। ছোট ভাই দেশের বাইরে থেকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছিল। কিছু টাকা অন্যজনেরও, আমারও বেশকিছু টাকা জমা ছিল। হঠাৎ একটি ফোন এলো। অ্যাকাউন্টের সমস্যার কথা বলে ভেরিফিকেশন কোড চাইলে আমি দিয়ে দেই। পরে দেখি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। যাদের টাকা ছিল এখন সেই টাকাও আমাকে দিতে হবে।
প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কখনো কোনো গ্রাহকের পিনকোড, পাসওয়ার্ড জানতে চায় না। এরপরও মানুষ প্রতারকের ফাঁদে পা দেয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সূত্রমতে, ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে ৯৮টি মামলার মধ্যে ৩২টি মামলা হয়েছে শুধু প্রতারণার। অর্থাৎ মোট মামলার ৩১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
আর্থিক প্রতারণার জন্য ভয়ভীতিসহ নানা কৌশল গ্রহণ করে প্রতারকরা। চলতি বছরের ১৯ আগস্ট ময়মনসিংহ থেকে সহযোগীসহ এক প্রতারকচক্রের মূলহোতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) গুলশান বিভাগ। ‘মাদকসহ ধরা পড়েছে আপনার ছেলে’ গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে এমন ফোন আসে এক মায়ের কাছে। বলা হয় ৬০ হাজার টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পেশায় চিকিৎসক মা ছেলেকে বাঁচাতে কোনো যাচাই না করেই পুলিশ পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টে ৩০ হাজার করে মোট ৬০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন।
শুধু এই মা নন, এভাবে আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। মূলত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের টার্গেট করে তারা। প্রতারণার শিকারদের মধ্যে চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রকৌশলীও রয়েছেন। এতে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার নারীরা।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গত ১৪ মাসে চক্রের সদস্য বিনিয়ামিন নামে ওই ব্যক্তি একটি নম্বরে বিকাশ ও নগদে এক কোটি ১৬ লাখ টাকার লেনদেন করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নগদ ও বিকাশ নম্বর সংগ্রহ করে প্রতারণার টাকা সংগ্রহে সেই নম্বরগুলো ব্যবহার করা হতো। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিনই প্রতারণার কাজ করতো চক্রটি। গড়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো তারা। প্রতারণার জন্য চক্রটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অভিভাবককে ছেলে হলে বলতো ‘মাদকসহ আটকের কথা’, ছাড়াতে হলে এখনই বিকাশ কিংবা নগদে এক লাখ টাকা পাঠাতে হবে। মেয়ে হলে বলা হতো- ‘আপনার মেয়ে অসামাজিক কাজে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, টাকা লাগবে এক লাখ’।
প্রতিনিয়ত এভাবে পরিবর্তন হচ্ছে প্রতারণার ধরন। নাগরিকদের নিরাপত্তায় নতুন নতুন নিরাপত্তা কৌশল অবলম্বন করে পুলিশও। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, এটা প্রথমতো ব্যক্তিগত দায়। তাই ব্যক্তিকেই প্রথমে সচেতন হতে হবে। আর যখনই এমন ঘটনা ঘটবে পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশের একটি আইসিটি উইং আছে যারা এগুলো নিয়ে কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজরদারি থাকলেও ডিজিটাল প্রতারণার এই মাধ্যমগুলো ব্যক্তিগত হওয়ায় পুলিশের নজরদারির সুযোগ খুবই কম। এ সুযোগ না থাকার ফলে এই মাধ্যমগুলোতে হয়তো প্রতারণা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পাশাপাশি মানুষকে সচেতন হতে হবে। আমাদের বিট পুলিশিংয়ে এ বিষয়ে সচেতন করা হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আর্থিক প্রতারণা নতুন নয়, তবে একেক সময় একেকভাবে ঘটে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী কিংবা অল্পশিক্ষিত মানুষের কিছু মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস থাকায় এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়। ডিজিটাল প্রতারণা রোধে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা।
তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হলে সেই অর্থ কীভাবে আদায় করা যায় সেই প্রক্রিয়াও স্পষ্ট নয়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে অর্থ আদায়ের ব্যবস্থার জন্য সফলভাবে পদক্ষেপ নেন সেটাও আমরা দেখছি না। অপরাধচক্রের প্রযুক্তিগত যে জ্ঞান সেটি প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিহত করার জায়গাটিও আমরা দেখছি না। আবার এসব অপরাধ দমনে যথাযথ আইনও নেই। অপরাপর আইনের সহযোগিতা নিতে হয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ার ফলেই এ ধরনের অপরাধ বিরাজ করছে।
আরএসএম/এএসএ/এমএস