ট্রেনের টিকিটের ‘চাহিদা বাড়লে বাড়তি দাম’ চায় রেলওয়ে
চাহিদা বাড়লে বাড়বে ভাড়া, চাহিদা কমলে কমবে- দেশে ট্রেন পরিচালনায় এমন পদ্ধতি চালু করতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রিতে চালু থাকা এই নিয়ম দেশের ট্রেনে চালু করতে জাতীয় সংসদের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে প্রস্তাব দিয়েছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল (রাজশাহী)। তবে এ বিষয়ে নিজেদের বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বা নির্দেশনা দেয়নি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
এছাড়া ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো, রেলের কোচ ও গতি বাড়ানো, ট্রেন ও স্টেশনে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার ব্যবস্থা করা, রেলস্টেশনগুলো বাণিজ্য হাবে পরিণত করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে রেলওয়ে। তবে এগুলোর কোনোটির বিষয়ই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো রেলওয়েও বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে চলছে। তাই গত জুনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে নির্দেশনা দেয় সংসদীয় কমিটি। পরে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। ওই কমিটির প্রতিবেদনে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো, ভূমি ব্যবস্থাপনা, সঠিক রেল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও জনবল কাঠামোর উন্নয়নের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
এর মধ্যে ‘ট্রেনের টিকিটের চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, চাহিদা কম থাকলে দাম কমবে’, এমন প্রস্তাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পদ্ধতিতে কিছু টিকিট সংরক্ষিত থাকবে। জরুরি প্রয়োজনে বেশি ভাড়া দিয়ে এই টিকিট কিনতে পারবেন যাত্রীরা।
গত ৪ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় প্রতিবেদনটি জমা দেয় রেলওয়ে। তবে সভায় ওই প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি কমিটি। ফলে প্রস্তাবটি এখনো ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: রেলে ৫ বছরে লোকসান ৪২৩১ কোটি টাকা
রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রস্তাবটি সংসদীয় কমিটি অনুমোদন দিলে রেলওয়ের আয় বাড়বে। বছরে লোকসান বা ভর্তুকির পরিমাণ কমবে। রেলওয়ের সেবার মানও বাড়বে।
উৎসব এলেই টিকিটের জন্য ‘যুদ্ধ’ শুরু হয় কমলাপুরে
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন রেলওয়ের অংশীজন ও বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলছেন, রেলওয়ের সেবার মান না বাড়িয়ে ভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। রেলওয়ে যেহেতু একটি সরকারি সংস্থা, এখানে লাভ বা আয়ের হিসাব করার অবকাশ নেই। বরং রেলওয়ে বছরে কোন খাতে কত টাকা আয় করে, আর কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করে- এই হিসাব জনগণকে দিতে হবে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, রেলে যাত্রী পরিবহন বা চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রেলের অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং যাত্রী দুর্ভোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে রেলওয়ের প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আগে এগুলো ঠিক করতে হবে।
যা আছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিবেদনে
গত ৪ আগস্ট রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল বলেছে, দেশে ঈদ, পূজার মতো বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির সময় ট্রেনে যাত্রীর চাপ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন করে ট্রেন। এতে কোচের ক্ষতি হয়। আর্থিকভাবেও রেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া যাত্রীদেরও ভোগান্তি বেড়ে যায়। তাই উড়োজাহাজের টিকিটের মতো চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়বে, চাহিদা কম থাকলে ভাড়া কমবে- এই পদ্ধতিতে ট্রেনের টিকিটের দাম বাড়ানো যেতে পারে। এতে রেলের আয়ও বাড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই পদ্ধতিতে ট্রেন পরিচালনা করে।
আরও পড়ুন: অনলাইন বন্ধ, সশরীরে টিকিট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা-ভোগান্তি
এছাড়া রেলওয়ের প্রতিটি স্টেশনকে একটি বিজনেস হাব করা সম্ভব। স্টেশনগুলোর বাইরে চাহিদা অনুযায়ী বহুতল ভবন করে বাণিজ্যিকভিত্তিতে মার্কেট করা যেতে পারে।
সব রুটে ট্রেনের ডাবল লাইন এবং ট্রেনের গতি বাড়ানোর সুপারিশ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-জয়দেবপুর সেকশনটি জটিল। এখানে প্রায় ৫০টি ক্রসিং রয়েছে। এজন্য ট্রেন ঘণ্টায় মাত্র ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোতে আন্ডার গ্রাউন্ড বা ব্রিজের মতো করা গেলে ট্রেনের গতি বাড়বে। আর মালবাহী ট্রেনে যেহেতু আয় বেশি হয়, সেজন্য মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকো মাইটার, লোকোমোটিভ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
জীবনের এমন ঝুঁকি নিয়েও চলে ট্রেনযাত্রা
রেলওয়েতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ দিলে রেল আয় করতে পারে জানিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রেন, স্টেশন এবং রেলের জমিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার করার ব্যবস্থা করা গেলে আয় বাড়ানো যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে রেল আয় করে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে রেলের জমিতে তারকা আবাসিক হোটেল, মার্কেট করা যায়।
আরও পড়ুন: সহজে ট্রেনের টিকিট মেলে না ‘সহজ-এ’
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজশাহী অঞ্চলের (পশ্চিম) মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, রাজশাহী থেকে ট্রেনে ঢাকার ভাড়া ৩৪০ টাকা। একই রুটে বাসের ভাড়া ৭২৫ টাকা। ফলে সব লোক বাস ছেড়ে রেলে ভ্রমণ করতে চান, যা ট্রেনের সক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। তারা ট্রেনের টিকিটের জন্য স্টেশন কাউন্টারে গিয়ে বকাবকি করেন। আবার যারা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করার জন্য টিকিট নেন, তারা ট্রেনে উঠে এসি বগিতে গিয়ে ভিড় করেন। এ নিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো ট্রেনে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। তাই ট্রেনে চাপ কমাতে ভাড়া কিছুটা বাড়াতে তারা প্রস্তাব করেছেন।
বিমানের মতো ট্রেনের টিকিট পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে অসীম কুমার তালুকদার বলেন, বিমানে যাতায়াতে চাহিদা বাড়লে টিকিটের দাম বেড়ে যায়। ভারতের রেল ব্যবস্থাপনায়ও এমন পদ্ধতি চালু আছে। এতে যার জরুরি টিকিট দরকার, সে বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভ্রমণ করবেন। টিকিট নিয়ে বিশৃঙ্খলা কমবে।
তিনি বলেন, রেলওয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্যই তারা সংসদীয় কমিটিতে ওই প্রস্তাব করেছেন। যদিও সংসদীয় বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কারণ, ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোসহ অন্য বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মনিটরিং করছেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে শনিবার (২০ আগস্ট) সন্ধ্যায় তার মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ‘কথা বলতে অপারগতা’ প্রকাশ করেন।
এমএমএ/এমএইচআর/এসএইচএস/এমএস