ডেটিং অ্যাপে বন্ধুত্ব-প্রেম-ডেট, অতঃপর...
দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডেটিং অ্যাপ। দেশে একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকার পরেও গোপনে চলছে প্রিয়জনের সন্ধান। এ ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে প্রথমে হচ্ছে বন্ধুত্ব। এরপর প্রেম, একান্তে সময় কাটাতে বাসায় আমন্ত্রণ। আর বন্ধুর আমন্ত্রণ রক্ষাই একসময় কাল হয়ে ওঠে। জিম্মি করে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র।
ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারী ভুক্তভোগীরা বলছেন, দেশে বর্তমানে টিন্ডার, মিনগেল ২, ট্যানট্যান, চ্যাটিউ, নিনবো, ব্যাডো, হ্যাপন, ল্যামঅ্যাওয়ার, ট্যাগড, লভো, হাই ৫, ওয়াপলগ, সিএসএল, বু, মামবা, উওপ্লাস ও জয়ি ছাড়াও বেশকিছু অ্যাপ চালু রয়েছে। যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও একাকিত্ব কাটাতে কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসব অ্যাপের প্রতি ঝুঁকছেন। এ সুযোগ নিচ্ছে অনলাইন প্রতারকচক্র। এসব অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারকচক্রের নারী সদস্যরা প্রথমে বন্ধুত্ব ও পরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিছুদিন কথাবার্তার একপর্যায়ে একান্তে সময় কাটানোর কথা বলে পুরুষ সঙ্গীকে বলেন দেখা করতে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দশটির মতো ডেটিং অ্যাপ বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু অ্যাপগুলো এখনো সক্রিয়।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, কিছুদিন আগে টিন্ডার অ্যাপে ৩৭-৩৮ বছর বয়সী একজন পুরুসের সঙ্গে ৩০ বছর বয়সী এক নারীর পরিচয় হয়। দুজনেই বিবাহিত। এরপর তারা সময় কাটানোর জন্য কক্সবাজার যান। সেখানে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একটি হোটেলে ওঠেন। তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়। সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও তারা নিজেরাই মোবাইলে ধারণ করেন। ঢাকায় ফেরার পর ওই পুরুষের স্ত্রী মোবাইলে সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও দেখতে পান। এরপর ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়ায়। পরবর্তীসময়ে তাদের মধ্যে তালাক হয়ে যায়।
আরও পড়ুন>> লাইকি-বিগো লাইভে প্রতারণা, চীনা নাগরিক গ্রেফতার
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মুরাদ আহমেদ (ছদ্মনাম) জাগো নিউজকে বলেন, আমি অবসর সময়ে মাঝে মধ্যে বিগো লাইভ ও টিন্ডারসহ আরও কয়েকটি ডেটিং অ্যাপে লাইভ চ্যাটিংয়ে যুক্ত হতাম। এর মধ্যে অনেক মেয়ের সঙ্গে আমার ভার্চুয়ালি আলাপ হয়েছে। এসব অ্যাপে মেয়েদের আলাদা আলাদা গ্রুপ আছে। এসব গ্রুপে যুক্ত হলে অনৈতিক কাজ করার প্রস্তাব দেয়। এসব গ্রুপের অধিকাংশ নারী খোলামেলা পোশাক পরে ছেলেদের আকৃষ্ট করেন।
মুরাদ আরও বলেন, ভিডিও চ্যাটিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চক্রের নারী সদস্যরা ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মাধ্যমে বিকাশ/নগদ নম্বর দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে বলেন। কিন্তু টাকা পাঠানোর পর বেশিরভাগ নারী গ্রুপ থেকে বের করে দেন। তবে এসব অ্যাপ যারা নিয়মিত ব্যবহার করেন তাদের অনেকে সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন চক্রের নারী সদস্যরা। সম্পর্কের একপর্যায়ে সরাসরি ডেটিংয়ের প্রস্তাব দেন। যারা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ডেটিংয়ে যান তারাই সব খোয়ান।
তিনি বলেন, দেশের সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব অ্যাপ ব্যবহার উচিত নয়। তবুও একশ্রেণির মানুষ, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রবাসী এ অ্যাপ ব্যবহার করেন।
টিন্ডার অ্যাপের মাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন সোনিয়া মেহের। বন্ধুত্বের একপর্যায়ে প্রেম। এরপর একান্তে সময় কাটানোর কথা বলে ছেলে বন্ধুকে ডেকে নিয়ে যেতেন নির্জন স্থানে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মেয়েটির বাবাসহ চক্রের সদস্যরা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে আগেই সেখানে অবস্থান করতেন। সেখান থেকে ওই ছেলে বন্ধুকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো এক ফ্ল্যাটে। সেখানে আটকে রেখে চক্রের নারী সদস্যদের সঙ্গে জোরপূর্বক অশ্লীল ছবি তোলা হয়। পরে ওই ছবি ভুক্তভোগীর স্বজনদের কাছে পাঠানোর কথা বলে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। একপর্যায়ে ভুক্তভোগীকেই বাধ্য করা হয় স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আনতে। তখন মানসম্মানের ভয়ে ভুক্তভোগী স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আনতে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুন>> টিকটক-বিগো লাইভ-পাবজি-ফ্রি ফায়ার-লাইকি বন্ধে হাইকোর্টে রিট
এভাবে ডেটিং অ্যাপের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করে টাকা আদায়ের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পুলিশ বলছে, এক ব্যক্তি ও তার মেয়ে চক্রের অন্যতম সদস্য। পুলিশ অন্তত ১৫টি বিদেশি ডেটিং অ্যাপ শনাক্ত করেছে।
ডিবি জানায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন এক ভুক্তভোগী। এরপর রামপুরা এলাকা থেকে চক্রের সদস্য আবদুল জলিল হাওলাদার (৫৬), তার মেয়ে সোনিয়া মেহের (১৮) ও তাদের এক সহযোগী ইউসুফ মোল্লাকে (৪৩) গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত এক বছরে ১০ জনকে অপহরণ করে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন এ চক্রের সদস্যরা। এ চক্রে চার নারী ও পাঁচ-ছয়জন পুরুষ সদস্য আছেন। জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের চার সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন মামুন, রাজু, বীথি ও মিথিলা।
টিন্ডার অ্যাপ ব্যবহার করে যেভাবে ফাঁদে ফেলা হয়
ডেটিং অ্যাপে ৩০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন চক্রের সদস্যরা। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলা শুরু করতেন সোনিয়া মেহের। এরপর ওই ব্যক্তিকে অপহরণ করা হতো। রাজধানীর রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে এভাবে অপরাধ চালিয়ে আসছিল চক্রটি।
আরও পড়ুন>> লাইকি-বিগো লাইভে অশালীন ভিডিও দেখিয়ে প্রবাসীদের প্রলুব্ধ
ডিবি সূত্র জানায়, সম্প্রতি টিন্ডার ডেটিং অ্যাপে যুক্ত হন এক তরুণ। কিছুদিন পর ওই অ্যাপের মাধ্যমে পরিচয় হয় সোনিয়া মেহেরের সঙ্গে। পরিচয় সূত্রে মোবাইল নম্বর দেওয়া-নেওয়া, সেখান থেকে দুজনের মধ্যে শুরু হয় কথাবার্তা। একপর্যায়ে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। এরপর একান্তে সময় কাটানোর কথা বলে কম জনবহুল এলাকায় ডেকে নিয়ে ওই তরুণকে অপহরণ করেন চক্রের সদস্যরা। তাকে আটকে রেখে পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে রাজি না হলে ওই তরুণকে মারধর করা হয়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলে দুই লাখ টাকা দেয় ওই তরুণের পরিবার। তাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে ভয়ভীতি দেখিয়ে চক্রের সদস্যরা বলেন, বাড়িতে ফিরে আরও টাকা দিতে হবে।
ওই তরুণ পুলিশকে জানান, বাড়িতে ফেরার পরও বারবার টাকা দাবি করে আসছিলেন চক্রের সদস্যরা। টাকা না দিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তারা। পরে যাত্রাবাড়ী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণ।
ডিএমপির গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। ডেটিং অ্যাপস ব্যবহার করে একদিকে যেমন মানুষের নীতি-নৈতিকতা নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে এসব মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছে কেউ কেউ আবার অপহরণ চক্রের খপ্পরে পড়ে খোয়াচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। ডেটিং অ্যাপসে পরিচয়ের পর শারীরিক সম্পর্কে অনেকের ভেঙে যাচ্ছে সংসার। এমন বেশকিছু অভিযোগ পাওয়ার পরে প্রায় ১০টির মতো ডেটিং অ্যাপস বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ জানানো হয়।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, শুধু কম বয়সী নয়, বেশি বয়সীরাও ঝুঁকছে ডেটিং অ্যাপের দিকে। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে অনেকেই টাকা-পয়সা খোয়ানোর অভিযোগ করেছেন। এসব কারণে আমরা কিছু ডেটিং অ্যাপস বন্ধে সুপারিশ করেছিলাম।
এসব ডেটিং অ্যাপস বন্ধে বিটিআরসির সক্ষমতা আছে কি না জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, ডেটিং অ্যাপস ব্যবহার করে অপরাধ হচ্ছে এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। আমাকে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে আসলে বিষয়টি কী। গোয়েন্দা পুলিশ যে কাজ করছে তা অত্যন্ত ভালো কাজ। যারা এসব ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধ করছে তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, গুগল প্লে-স্টোর আমরা বন্ধ করতে পারি না। যে কেউ ডাউনলোড করে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে বিটিআরসির পক্ষ থেকে পাবজি-ফ্রি ফায়ারের মতো কিছু অ্যাপস বন্ধ করা হয়েছিল। এরপরও অনেকেই বিকল্পভাবে ডাউনলোড করেছিলেন। একেবারে বন্ধ করতে হলে সম্পূর্ণ গুগল বন্ধ করে দিতে হবে, যা সম্ভব নয়। কাজেই এসব ডেটিং অ্যাপস ব্যবহার করে যারা অপরাধ করছেন তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
টিটি/এমএএইচ/এএসএ/জেআইএম