পদ্মা সেতু দিয়ে চলতে ১০০ রেলকোচ প্রস্তুত হচ্ছে চীনে
২৫ জুন উদ্বোধনের পর যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে পদ্মা সেতুতে। দ্বিতল বিশিষ্ট এ সেতুর নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। এরই মধ্যে ট্রেন চলাচলের দিনক্ষণও ঠিক করা হয়েছে। সড়ক সেতু অংশের ঠিক এক বছর পর ২০২৩ সালের জুনে উদ্বোধন হবে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’। ১৭২ কিলোমিটার এ রেলপথ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যাবে যশোর।
প্রথম ধাপে চালু হবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা পর্যন্ত। ৮২ কিলোমিটার এ রেলপথ ২০২৩ সালের জুনে খুলে দিতে পুরোদমে কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয়।
বাংলাদেশের রেলপথ মানেই ব্যালাস্ট্রেড। এ রেলপথে গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করা হয়। থাকে ইস্পাতের স্লিপার ও কাঠের বন্ধন। পাথর দেওয়ার কারণ হচ্ছে যাতে ট্রেন লাইনচ্যুত না হয়। তবে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের উড়ালপথ অংশে কোনো পাথর থাকবে না। অত্যাধুনিক এ উড়াল রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে ট্রেন।
নতুন এ রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টেশনে স্লিপারসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী মিলে প্যানেল তৈরি হচ্ছে। পরে মেশিনের সাহায্যে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে রেলপথে। এতে দ্রুতসময়ে রেলপথ নির্মিত হবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে একসঙ্গে ২৫-৩০টি স্লিপার মিলে একটি প্যানেল তৈরি করা হচ্ছে। স্লিপারের সঙ্গে সঙ্গে বসে যাচ্ছে রেলপথও। এ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি আধুনিক প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ (কোচ) সংগ্রহ করা হবে। এগুলো নির্মিত হচ্ছে চীনে। একদিকে রেলপথ নির্মাণকাজ এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে চীনে তৈরি হচ্ছে রেল কোচ। ১০০টি প্যাসেঞ্জার ক্যারেজের মধ্যে ৩২টি চলতি বছরের নভেম্বরে চীন থেকে পাঠানো হবে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্ক) আবু ইউসুফ মোহাম্মদ শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের পর রেলপথ নির্মাণে খুব বেশি দেরি হবে না। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০২৩ সালের জুনে চালুর জন্য কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ চলমান। ভূমি অধিগ্রহণের পরে পাথর বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্টেশনগুলোতে তৈরি হচ্ছে স্লিপার ও রেলপথ প্যানেল। এরপর মেশিনের সাহায্যে রেলপথে সেই প্যানেল বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত পাথরের ওপর একটা করে স্লিপার বসানো হয়, কিন্তু এখানে একটা প্যানেল বসানো হচ্ছে যেখানে একাধিক স্লিপার থাকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে রেলপথ তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে চীনে তৈরি হচ্ছে ১০০টি কোচ। কোচগুলো পর্যায়ক্রমে দেশে আসবে। পদ্মা সেতু হয়ে কোচগুলো এ রেলপথে চলাচল করবে।’
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। নতুন করে রেল নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত হবে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল। পাশাপাশি বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে ঢাকা-যশোর-বেনাপোল-কলকাতা পর্যন্ত এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপিত হবে। ফলে এ রুটে জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ফ্রেইট, ব্রডগেজ কনটেইনার ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। নতুন এ লাইন স্থাপনের ফলে ১ হাজার ৬৮০টি নতুন পদ সৃষ্টি হবে। লোকবল নিয়োগের চাহিদা প্রস্তুত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো— ঢাকা-গেন্ডারিয়া অংশের ইউটিলিটি শিফটিং, নড়াইলের প্রায় ১১ একর জমি অধিগ্রহণ করে ঠিকাদারকে সাইট বুঝিয়ে দেওয়া।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ উন্নয়ন করা এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পের আওতায় মেইন লাইন ও লুপ লাইনসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৩৭৭ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল রেলপথ), ৬৬টি মেজর ব্রিজ, ২৪৪টি মাইনর ব্রিজ নির্মাণের সংস্থান রয়েছে। ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ ও ৬টি বিদ্যমান স্টেশন রিমডেলিং করা হবে। ২০টি স্টেশনেই স্থাপন করা হবে টেলিযোগাযোগসহ আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা। সংগ্রহ করা হবে ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ।
জানা যায়, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে চায়নার ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ এবং সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি
চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। কাজের মোট গড় অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা থেকে ভাঙ্গা অংশ চালুর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কাজ চলছে মোট তিনটি ফেজে ভাগ হয়ে। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। এছাড়া মাওয়া-ভাঙ্গা ৭৮ দশমিক ৫ ও ভাঙ্গা থেকে যশোরের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন মাসে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রকল্পের মেজর ব্যয়ের খাত হলো— রেলওয়ের স্থাপনা নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ, পেশাগত সেবা ক্রয় ইত্যাদি। সব অঙ্গভিত্তিক ব্যয়ের ওয়েটেড অ্যাভারেজ হিসেবে বাস্তব অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আর্থিক অগ্রগতি ৫৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। রিসোর্স মোবিলাইজেশন হিসেবে ২০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় থেকে প্রায় তিন বছর ১০ মাস পার হয়েছে।
মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের এমব্যাংকমেন্ট, ব্রিজ-কালভার্ট, আন্ডারপাস, ভায়াডাক্ট নির্মাণ ইত্যাদি কাজের অগ্রগতি শতভাগ। রেলস্টেশন ভবন নির্মাণের মধ্যে তিনটির মূল ভবনের কাজ শুরু হয়েছে এবং মাওয়া স্টেশনের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন। ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। ভাঙ্গা স্টেশন থেকে রেলপথ স্থাপন কাজ শুরু হয়েছে। এ অংশের অন্যান্য নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ভাঙ্গা জংশন স্টেশনের নতুন ও পরিবর্তিত ডিজাইন পেতে বিলম্ব হওয়ায় এর কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে।
দীর্ঘ মধুমতি রেল সেতুর কাজ চলমান
ভাঙ্গা-যশোর অংশে বর্তমানে এমব্যাংকমেন্ট, ব্রিজ-কালভার্ট, আন্ডারপাস নির্মাণকাজ চলমান। এর মধ্যে ব্রিজ নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ, কালভার্ট-আন্ডারপাস নির্মাণের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ হলেও এমব্যাংকমেন্ট কাজের অগ্রগতি ৪৭ শতাংশ। প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সেতু হলো মধুমতি রেলসেতু (যার দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ২ কিলোমিটার)। বর্তমানে সেতুটির দুটি পিয়ারের পাইলিংয়ের কাজ চলমান। অবশিষ্ট পিয়ার ও এমব্যাংকমেন্টের সব পাইল নির্মাণ শেষ। এরই মধ্যে চারটি স্প্যানে স্টিলগার্ডার স্থাপন করা হয়েছে এবং সার্বিক অগ্রগতি সন্তোষজনক।
এ নদীর নদীশাসন কাজও শুরু হয়েছে। তবে, এ অংশে আটটি নতুন স্টেশন ভবনের মধ্যে একটির কাজও শুরু হয়নি। অ্যালাইনমেন্টের অধিকাংশ এলাকা হাওরবেষ্টিত বলে সফট সয়েল ট্রিটমেন্ট (পিভিডি) কাজ করতে হয়েছে।
চলমান ন্যাশনাল হাইওয়ে রেলপথের কাজ
ভাঙ্গা-যশোর অংশে পাঁচটি জায়গায় ন্যাশনাল হাইওয়ে অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে একটি জায়গায় গ্রেড সেপারেশন আন্ডারপাস প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে, যা যশোর-নড়াইল হাইওয়ের তুলারামপুর এলাকায় পড়েছে। বাকি চারটি জায়গায় লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণ করা হবে। ভবিষ্যতে সওজের মাধ্যমে রাস্তা এক্সপানশন করার সময় যাতে ওভারপাস নির্মাণ করা হয় সে বিষয়ে কাজ চলমান।
ভূমি অধিগ্রহণ
ভূমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৪২৬ একর। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ২ হাজার ৮০ দশমিক ৪৩ একর। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোর জেলার ৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন এবং অবশিষ্ট ভূমি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে চাহিদার ভিত্তিতে প্রক্রিয়াকরণ করা হবে।
ইউটিলিটি শিফটিং
ইউটিলিটি শিফটিংয়ের জন্য তিতাস গ্যাস, ঢাকা ওয়াসা, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ সাইটে ইউটিলিটি শিফটিংয়ের কাজ সম্পন্ন। কিছু স্থান বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নড়াইল, ফরিদপুর ও যশোর জেলায় ইউটিলিটি শিফটিংয়ের কাজ এখনো চলমান।
এমওএস/এমএএইচ/এএসএ/জেআইএম