ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

জঙ্গিবাদে জড়ানো ৭৩% সাধারণ শিক্ষার্থী, মাদরাসার ২৩%

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় | প্রকাশিত: ১২:২৮ পিএম, ০১ জুলাই ২০২২

জঙ্গিবাদে বেশি জড়াচ্ছেন ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীরা। মাদরাসার তুলনায় সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার হার বেশি। ১ দশমিক ৬ শতাংশের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেই। সচ্ছল পরিবারের তরুণরাই পারিবারিক, রাজনৈতিক, ভাবাদর্শগতসহ একাধিক কারণে বিভিন্ন ধাপে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন। যাদের অধিকাংশেরই অভিভাবকরা শুরুতে বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছেন না।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সিটিটিসির তথ্যমতে, জঙ্গিবাদে জড়ানো তরুণদের মধ্যে ৭৩ শতাংশের বেশি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ২৩ শতাংশ। ভোকেশনালের ২ দশমিক ১ শতাংশ। আর শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এমন রয়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ।

২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার ৫৭২ জঙ্গির তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কেও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সাধারণত ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনা অনেক কম থাকে। ফলে জঙ্গিবাদের ইন্ধনদাতারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে খুব সহজেই তাদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হন। নতুন করে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত ব্যক্তিদের অধিকাংশই তরুণ ও আত্মকেন্দ্রিক।

সিটিটিসি বলছে, যাদের ধর্ম সম্পর্কে সীমিত ও অপর্যাপ্ত জ্ঞান, দোষী সাব্যস্ত ও বিচারাধীন কয়েদি, উগ্রবাদে জড়িত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য, হতাশ তরুণ যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে তারা সন্ত্রাসবাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

সিটিটিসির জরিপ অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ০-১৪ বছর বয়সীরা ০ দশমিক ২ শতাংশ, ১৫-১৯ বছর বয়সীরা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০-২৪ বছর বয়সীরা ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ২৫-২৯ বছর বয়সীরা ২০ দশমিক ১ শতাংশ, ৩০-৩৪ বছর বয়সী ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ৩৫-৩৯ বছর বয়সীরা ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ৪০-৪৪ বছর বয়সীরা ৮ দশমিক ০ শতাংশ, ৪৫-৪৯ বছর বয়সী ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫০-৫৪ বছর বয়সী ১ দশমিক ৪ শতাংশ, ৫৫-৫৯ বছর বয়সী ০ দশমিক ৬ শতাংশ, ৬০-৬৪ বছর বয়সী ০ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৬৪ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের মধ্যে ০ দশমিক ২ শতাংশ।

যে কারণে মানুষ উগ্রবাদের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে
জঙ্গিদের ওপর পরিচালিত সিটিটিসির গবেষণায় যে ছয়টি ধাপে জঙ্গিবাদে জড়ানোর কথা বলা হয়েছে তার প্রথম ধাপে রয়েছে হতাশা, বঞ্চনা বা পারিবারিক সমস্যায় নাজুক ব্যক্তি মুক্তির আশায় ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহী হওয়া। দ্বিতীয়ত, আশপাশে বা ইন্টারনেটে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্রবাদী রিক্রুটারের সংস্পর্শে আসা। তৃতীয়ত, পুরোনো শখ ও বন্ধুদের এড়িয়ে নতুন সমমনা বন্ধুদের খুঁজে নেওয়া এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত শলাপরামর্শ করা। চতুর্থত, শর্টকার্ট (সংক্ষিপ্ত) উপায়ে পারলৌকিক প্রাপ্তির লোভে বিভোর হয়ে পড়া। পঞ্চমত, যে কোনো কর্মকাণ্ড এমনকি সহিংসতাকেও নিজ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সঠিক বলে মনে করা। সবশেষে রয়েছে সহিংস উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া।

বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাদের পরিবার ও শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করে এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, উগ্রবাদে দীক্ষিত হওয়ার জন্য অন্য যে কোনো কিছুর তুলনায় পরিবেশ, বন্ধু ও পরিচিতজনরা তরুণদের বেশি প্রভাবিত করে। এর পেছনে শিক্ষার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম, সেটা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাই হোক আর ইংরেজি মিডিয়ামই হোক আর মাদরাসাই হোক।

সিটিটিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পড়ানো হয় না। তারা মাতৃভূমির তুলনায় পশ্চিমা দেশগুলো সম্পর্কে বেশি জানে। ফলে তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। অন্যদিকে মাদরাসায়ও দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা কম দেওয়া হয়। এতে তারাও ঝুঁকিতে থাকে।

jagonews24

তিনি বলেন, ইসলামের ইতিহাস, সংস্কৃতি কিংবা পশ্চিমা ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীরা যদি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে না-ই জানে, তবে তাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠবে কীভাবে? এ ধরনের শিক্ষার্থীদেরই জঙ্গিবাদে সহজে উদ্বুদ্ধ করা যায়।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬ সালের হলি আর্টিসান হামলার পর কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ ২৩টি ‘হাই রিস্ক অপারেশন’ পরিচালনা করে সিটিটিসি। কল্যাণপুরে অপারেশন স্টর্ম-২৬, নারায়ণগঞ্জে অপারেশন হিট স্টর্ম-২৭, গাজীপুরের পাতারটেকে অপারেশন স্পেট-৮ সহ সিটিটিসি ২৩টি হাই-রিস্ক অপারেশন পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ৬৩ জন জঙ্গি নিহত হয়। সিটিটিসি তদন্ত শেষ করা দুটি মামলায় (হলি আর্টিসান ও অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড) রায় হয়েছে যেখানে ১২ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিটিটিসির অভিযানগুলোর জন্য দেশে জঙ্গিদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

হলি আর্টিসানে নৃশংস হামলার পর গত ছয় বছরে সিটিটিসি একের পর এক সফল অভিযানের মাধ্যমে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে প্রতিহত করেছে।

তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের ধরনটা পরিবর্তনশীল। এক সময় শুধু কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়াতো বা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতো। পরে সাধারণ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়ায়। যারা ছিল জেএমবির সদস্য। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীসময়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের প্রযুক্তি শাখাকেও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে। সেই হিসেবে তারা মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জঙ্গিরা প্রচার-প্রচারণা চালায়।

আসাদুজ্জামান আরও বলেন, জঙ্গিরা প্রথমে টার্গেট সিলেক্ট করে এরপর দাওয়াত দেয়। দাওয়াতে যারা উদ্বুদ্ধ হয় তারাই জঙ্গিদের সংগঠনে আনতে সক্ষম হয়। তবে বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। আগে যত সহজে জঙ্গি সংগঠনগুলো দাওয়াতি কার্যক্রম করতো, যত সহজে শিক্ষার্থীদের রেডিকালাইজ করতে পারতো এখন তারা (জঙ্গিরা) সেভাবে পারছে না। কারণ হচ্ছে দীর্ঘ সাত-আট বছরে তরুণ প্রজন্ম দেখতে পেয়েছে জঙ্গিপথ ভুলপথ এবং এর যে পরিণতি তাও তারা সচক্ষে দেখেছে। আমরা জঙ্গিবাদ মোকাবিলা ও দমনে অনেকখানি সক্ষম হয়েছি।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছি, এতে জঙ্গিবাদের স্থান বাংলাদেশে হবে না। তাদের থেকে আমরা একধাপ এগিয়ে আছি। এই মুহূর্তে আমাদের গোয়েন্দা তথ্যমতে, জঙ্গিদের আক্রমণাত্মক হওয়ার সামর্থ্য নেই।

তিনি বলেন, র‍্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত আড়াই হাজার এবং শুধু হলি আর্টিসান হামলার পরে ১ হাজার ৬৭৮ জন জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। র‍্যাবের জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলমান, ভবিষ্যতেও থাকবে। র‍্যাবের কাছে ১৬ জঙ্গি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের ডি-রেডিকালাইজেশনের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করতে চাইলে তাদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

টিটি/এএসএ/জিকেএস