ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

বুড়িগঙ্গায় ৪০ টাকায় রাত্রিযাপন

রাসেল মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৯:১৯ পিএম, ১৭ জুন ২০২২

রাজধানীর সদরঘাট, বাদামতলী, মিটফোর্ড এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় খেজুরের ব্যবসা করেন মো. নুরুল আমিন সাগর। জীবিকার তাগিদে ১০ বছর আগে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় ব্যবসা করতে আসা সাগরের ভাসমান ব্যবসার মতো রাত্রিযাপনও হয় ভাসমান বোর্ডিংয়ে। ভাসমান বোর্ডিংয়ে রাত্রিযাপন শেষে সকালেই ছোটেন খেজুরভর্তি খাঁচি (পাত্র) মাথায় নিয়ে। এ যেন এক ভাসমান মানব।

একই অবস্থা পটুয়াখালীর বাউফল থেকে ২০০৪ সালে ঢাকায় ব্যবসা করতে আসা মো. জাকির হোসেনের। বর্তমানে সদরঘাট এলাকায় আপেল, কমলা, আঙুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল বিক্রি করেন তিনি। পরিবার-পরিজন গ্রামে থাকায় ঢাকায় একা। এ কারণে নেননি কোনো বাসা ভাড়া। খরচ কমানো ও নানা ঝামেলা এড়াতে ২০০৪ সাল থেকেই থাকেন ভাসমান বোর্ডিংয়ে। সে সময় ২০ টাকা ভাড়া হলেও বর্তমানে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ৪০টাকায়।

রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে বুড়িগঙ্গার তীরে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভাসতে থাকা ৬টি নৌযানের গল্প এটি। এগুলো নদীতে যাত্রী পরিবহনের পরিবর্তে মানুষের থাকার উপযোগী করে রূপ দেওয়া হয়েছে ভাসমান আবাসিক হোটেলে (বোর্ডিং)। আর এই ভাসমান বোর্ডিংয়েই সর্বনিম্ন ৪০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ভাড়ায় থাকা যায় এক দিন। যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, হাসপাতালে রোগী দেখানোসহ, ঢাকায় এসে নানা কাজে আটকা পড়া মানুষ থাকেন কম খরচে ও নিরাপদে।

থাকার জন্য রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার প্রায় সবই আছে এই বোর্ডিংগুলোতে। প্রতিটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে কক্ষ আছে ৩৫-৫০টি। এর মধ্যে কয়েকটি দ্বৈত সিটের কক্ষ থাকলেও অধিকাংশ এক সিটের কক্ষ। যেখানে বৈদ্যুতিক আলো, ফ্যান, নিরাপদ খাবার পানি, টয়লেট, পত্রিকা পড়ার সুবিধা রয়েছে বোর্ডারদের জন্য। তবে শুরুতে যে বোর্ডিংয়ে খাবারের ব্যবস্থা ছিল সেই বোর্ডিংয়ে এখন আর খাবারের ব্যবস্থা নেই। বাহির থেকেই খাবার খেয়ে আসেন বোর্ডিংয়ে থাকা মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে বোর্ডিংগুলোর যাত্রা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা ঢাকায় যাতায়াত করতেন ব্যবসার কাজে। ব্যবসার কাজে আটকা পড়ায় হোটেলের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় কখনো কখনো পড়তেন থাকার সমস্যায়। ফলে কিছু ব্যবসায়ী-মহাজন তাদের সমস্যার কথা মাথায় রেখে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় তৈরি করেন ভাসমান বোর্ডিংগুলো। তখন নৌকার মধ্যে কাঠের তৈরি বোর্ডিং ছিল যেখানে খাওয়ানো হতো আর পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থা। সেসময় খাওয়ার জন্য টাকা নিলেও থাকার জন্য নেওয়া হতো না কোনো টাকা। স্বাধীনতার পর থাকার জন্যও টাকা নেওয়া শুরু হয়।

নব্বইয়ের দশকের পরে সংস্কার করে লোহা দিয়ে তৈরি করা হয় এগুলো। কয়েক বছর পর পর এই নৌযানগুলো ডকইয়ার্ডে পাঠিয়ে সংস্কার ও মেরামত করা হয়ে থাকে। পাঁচ যুগ ধরে এই বোর্ডিংগুলো সদরঘাট এলাকায় থাকলেও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের উন্নয়ন কাজের জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র নির্দেশে ২০২০ সালের শুরুতে মিটফোর্ড ঘাটে স্থানান্তর করা হয়।

jagonews24

সরেজমিনে বুড়িগঙ্গার মিটফোর্ড ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কাঠের তৈরি ছোট এবং পাঁচটি লোহার তৈরি নৌযানের বড় ভাসমান বোর্ডিং। এর মধ্যে কাঠের তৈরি বোর্ডিং ও লৌহার তৈরি অপর একটি ভাসমান বোর্ডিং অনেকটাই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বাকি উমা উজালা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বুড়িগঙ্গা নামে চারটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাসমান বোর্ডিংয়ে ওঠানামার জন্য নদীর পাড় থেকে রয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি সাঁকো। দ্বিতল ভাসমান বোর্ডিংগুলোতে নিচতলা ও দোতলায় দুপাশে সারিবদ্ধভাবে কক্ষ আর মাঝ দিয়ে রাস্তা। আবার কোনোটায় রয়েছে অতিথিশালা। বোর্ডিংগুলোতে প্রথম কক্ষেই থাকেন একজন ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার)। আর দুপাশের সারিতে এক সিট ও দুই সিটের কক্ষ যা কেবিন নামেও পরিচিত। রয়েছে উন্মুক্ত (ঢালা) বিছানার কক্ষ, যেখানে তিন-চারজন একসঙ্গে থাকেন নিজেদের কাঁথা বালিশ নিয়ে। ফলে এখানে থাকতে তাদের ভাড়া দিতে হয় জনপ্রতি মাত্র ৪০ টাকা। আর প্রতিটি কেবিনে রয়েছে তোশক, কাঁথা, বালিশ, ফ্যান ও লাইট। এক সিটের কেবিনের ভাড়া ১০০ টাকা, আর দুই সিটের কেবিনের ভাড়া দিনপ্রতি ১৫০ টাকা। একেকটি বোর্ডিংয়ে ৫০-৬০ জনের মতো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বোর্ডিংগুলোতে থাকতে পারেন শুধু পুরুষরাই।

বোর্ডিংয়ের মালিক ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হকার, দোকানি, ছোট ব্যবসায়ী, দিনমজুর ও ঢাকায় এসে যারা নানা কাজে আটকে যান তারাই থাকেন ভাসমান বোর্ডিংয়ে। এছাড়া সদরঘাট ও এর আশপাশের এলাকায় প্রচুর ভাসমান মানুষ রয়েছে যাদের থাকার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই, বেশি টাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে কিংবা আবাসিক হোটেলে থাকার সামর্থ্যও নেই। ফলে এসব মানুষ কম খরচে দিন শেষে নির্বিঘ্নে রাতযাপন করতেই ঠাঁয় নেন এই ভাসমান বোর্ডিংগুলোতে।

উমা উজালা ভাসমান বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপক কানাই দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, এখানে ২০ বছর ৩০ বছর ধরে থাকে এমন ব্যক্তিও আছে। এই এলাকায় যারা কাজ করে তারাই মূলত থাকে। তবে করোনার আগে সদরঘাট থেকে মিটফোর্ডে চলে আসায় এখানে লোকজন কম। সদরঘাটে অনেক যাত্রী এসে আটকা পড়তো। সেখানে শ্রমজীবী মানুষও বেশি ছিল। তারা সারাদিন কাজ করে রাতে এসে বোর্ডিংয়ে ঘুমাত।

৩০ বছর ধরে মিটফোর্ড এলাকায় পান সিগারেট বিক্রি করা মো. মোশারফ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকায় একা মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা কঠিন, নানা ঝামেলা। খরচও বেশি হয়ে যায়। ছোট ব্যবসা করি তাই এখানে কম খরচে একটা রুমে প্রতিদিন ১০০ টাকা দিয়ে থাকি। যখন বাড়ি যাই তখন ভাড়াও দিতে হয় না। বাসা বা মেসে থাকলে ভাড়া কিন্তু মাফ নাই।

jagonews24উন্মুক্ত এই জায়গায় থাকতে একেকজনকে দিতে হয় ৪০ টাকা

শুধু দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই নয়, অনেকে আবার রোগী নিয়ে এসে বা ঢাকায় কাজে এসে আটকা পড়েও থাকেন ভাসমান এসব বোর্ডিংয়ে। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে পিরোজপুর থেকে রোগী নিয়ে আসা মো. মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে বেশি লোক থাকা যায় না। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম আশপাশে থাকায় জায়গা আছে কি না। তখন একজন বলল এই বোর্ডিংয়ের কথা। এসে দেখলাম ভালই। হাসপাতালের একদম কাছে, ভাড়াও কম। এক রুম ১০০ টাকা।

সাতক্ষীরার শ্যামপুর থেকে আসা বিশ্বজিৎ সমদ্দার জাগো নিউজকে বলেন, হাইকোর্টে একটি শুনানি আছে রোববার। দুই দিন আগে আসলাম ঢাকায়। আবাসিক হোটেলে জীবনের নিরাপত্তা, মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি, নানা ভয় ও ঝুঁকি থাকে। এক মামার মাধ্যমে জানলাম বোর্ডিং খুব নিরাপদ। এখানে খেটে খাওয়া মানুষ থাকে, কোনো ঝুঁকিও নেই। আবার খরচও কম।

এদিকে স্থান পরিবর্তনের ফলে বোর্ডার কমেছে অনেক। আগে যেখানে প্রায় সবগুলো সিটই ভাড়া দেওয়া যেত এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এছাড়া আগের তুলনায় খরচও বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ঘাটের ইজারাদারদের দিতে হয় ২০০ টাকা, সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিলের কার্ড কিনতে হয় ২ হাজার টাকার। আর বিআইডব্লিউটিএকে মাসে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। এছাড়া বোর্ডিংয়ের কর্মচারীর বেতন মাসে ১২ হাজার টাকা এবং বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দিয়ে এখন ভাসমান বোর্ডিংগুলো থেকে আয় খুব সামান্যই হয় বলে জানান ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক মো. মোস্তফা।

তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমতি নিয়েই দাদা ও বাবা এই ব্যবসা করেছে, আমিও করছি। একটা মায়া লেগে আছে। এত পুরোনো একটা ব্যবসা। ছোটকাল থেকে আমি এই ব্যবসায় আছি। সদরঘাটে যখন ছিলাম ভালই ছিল। কিন্তু মিটফোর্ডে আসার পর লোক কম, খরচ অনেক বেশি। এখন ব্যবসা একেবারেই নেই।

আরএসএম/এমএইচআর/জিকেএস