ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘মধ্যবিত্তরা আর আদর্শবাদী থাকছে না’

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ০৮ জুন ২০২২

অধ্যাপক এম এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

প্রান্তিক কৃষি ব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বৈষম্যই এখন রাষ্ট্র, সমাজের বড় চ্যালেঞ্জ। মধ্যবিত্তের আয় না বাড়লে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না।

দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: কৃষকের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছেন, গবেষণা করছেন। সেচের পানি না পেয়ে দুজন আদিবাসী কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটলো সম্প্রতি। আত্মহত্যার এ ঘটনায় আপনার কাছে আলাদা পর্যবেক্ষণ আছে কি না?

এম এম আকাশ: অবশ্যই আলাদা করে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রতিটি আত্মহত্যাই দুঃখজনক ও কষ্টের। কিন্তু এই আদিবাসীর আত্মত্যার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, প্রান্তিক তথা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সদস্য। দ্বিতীয়ত, তারা কৃষক ও বরেন্দ্র অঞ্চলের সমতলে বাস করে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেখানে পানির অভাব থাকে এবং সেচ মৌসুমে পানি দিতে না পারলে ক্ষেতের পুরো ফসল নষ্ট হয়। ওই দুই কৃষকের সেচের পানির অভাব ছিল এবং পানি পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছিল। পানি না পাওয়ায় মনের দুঃখে তারা বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে, এমনটিই খবর এসেছে। সব মিলিয়ে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা নয় তো বটেই, উপরন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে দুঃখ পেয়ে দুজন মানুষের আত্মহত্যা।

জাগো নিউজ: এই দুঃখবোধের জায়গা থেকে কী বলা যায়?
এম এম আকাশ: দুঃখের কারণ তারা নিজেরা না। তারা বরং কষ্ট করে ফসল ফলিয়েছে। তাদের দরকার ছিল পানি এবং পানি পাওয়া ছিল তাদের অধিকার। এই অধিকার থেকে তারা কেন বঞ্চিত হলো এটিই হচ্ছে মৌলিক প্রশ্ন। কারা বঞ্চিত করলো? বঞ্চিত করা অবশ্যম্ভাবী ছিল নাকি লাভ ও লোভের কারণে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এটি তদন্ত করে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি বলে আমি মনে করি।

বরেন্দ্র অঞ্চলে লাভ ও লোভের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে আগে থেকেই। কারণ এ অঞ্চলে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হয়। এই গভীর নলকূপের সরকারি মালিকও আছে, বেসরকারি মালিকও আছে। বিএডিসি, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠান।

প্রাইভেট মালিকরা বাজারের নীতি অনুসরণ করে কাজ করেন, সুতরাং তাদের কাছে মুনাফার বিষয়টিই অধিক গুরুত্ব পায়। তারা তো দানবাক্স খুলে বসবে না। তবে মুনাফার ব্যাপারে অবশ্যই নীতি আছে। সেক্ষেত্রে খোঁজ নিতে হবে কী দামে সে মুনাফা নির্ধারণ করেছিল, যে দাম তারা দিতে পারেনি।

সাধারণত, এসব ক্ষেত্রে মালিকের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকে। ব্যাপারটি এমন কি না যে, আর কোনো মালিক বা বিকল্প ছিল না বিধায় মালিকের নির্ধারিত দাম দিতে বাধ্য নতুবা আত্মহত্যা! এত কষ্ট করে বোনা ফসল পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এটি তো সহ্য করার মতো নয়।

পানির দরকার পড়লে আগে কৃষককে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়। মূল্য পরেও আদায় করতে পারবে এবং সে ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে। হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসার মতো। আগে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা, পরে মূল্য আদায় করা। এ নীতি বেসরকারি হাসপাতালেও আছে। এ কারণে আমি বলছি, এই সেচ কাজে কার কী ভূমিকা ছিল তা বের করা জরুরি।

জাগো নিউজ: আদিবাসীদের সংকট তীব্র হচ্ছে। বিলীনও হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর জীবনধারা। আত্মহত্যার ঘটনায় সে দিকটাই উঠে এসেছে।

এম এম আকাশ: আদিবাসী জনগোষ্ঠী হচ্ছে গরিবের মধ্যে আরও গরিব। মূলধারার জনগোষ্ঠীর মধ্যে গরিব থাকলেও তার হয়তো ধনী আত্মীয়-স্বজন আছে। প্রাইভেট-পাবলিক সেক্টরে তাদের এক ধরনের প্রভাব থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ থাকে। কিন্তু সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর এই মানুষদের কেউ গুরুত্ব দেয় না। তারা এরই মধ্যে প্রান্তিকীকরণ হয়ে এক্সক্লুসিভ হয়ে গেছে। তারা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ধারায় ইনক্লুসিভ নয়। এই আত্মহত্যা রাষ্ট্র বা সমাজকে বার্তা দিচ্ছে যে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ করে ভাবতে হবে। বিশেষ করে সেচ ব্যবস্থায় প্রান্তিক কৃষকদের জন্য আলাদা করে বিধান তৈরি করতে হবে, যেখানে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা অনেকটাই সংঘবদ্ধ এবং তারা একটি শান্তিচুক্তি আদায় করে নিয়েছে। তবে তারাও এই সরকারের নানা কর্মকণ্ড নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছে। তার মানে সংগঠিত একটি গোষ্ঠীই চুক্তি অনুসারে তাদের অধিকার আদায় করতে পারছে না। আর সমতলের অসংগঠিত সাঁওতালরা তাদের অধিকার কীভাবে আদায় করবে! আর তারা কীভাবে বেঁচে আছে তা বলাই বাহুল্য।

জাগো নিউজ: এ ঘটনাকে সামগ্রিক কৃষকের চিত্র হিসেবে বিবেচনা করে কী বলা যায়?

এম এম আকাশ: সমাজে কৃষকই সবার আগে বঞ্চিত। তাদের অধিকার হরণ করেই অন্যরা প্রাচুর্য গড়ে তোলে। আমরা কৃষি কার্ডের কথা বলে আসছি বহু আগে থেকে। একজন বিত্তবান কৃষক যত সহজে রাষ্ট্র-সমাজ থেকে যেভাবে সুবিধা পায়, একজন গরিব বা প্রান্তিক কৃষক সে সুবিধা পায় না।
কৃষকের সংকট দূর করতে হলে তলানি থেকে ভাবতে হবে। একজন ধনী কৃষক দাম বেশি দিয়ে হলেও কৃষিসামগ্রী কিনতে পারেন। একজন গরিব কৃষক তা পারেন না।

জাগো নিউজ: অধিকার আদায়ের কথা বলছেন। আপনি কমিউনিস্ট পার্টি করছেন দীর্ঘদিন ধরে। কমিউনিস্ট পার্টির কৃষকদের নিয়ে সংগঠন ‘ক্ষেত মজুর সমিতি’ কাজ করছে। কৃষকের অধিকার আদায়ে কী দেখলেন?

এম এম আকাশ: আমি মনে করি, কৃষকের আত্মহত্যার মতো ঘটনা কোনো সমাধান নয়। কৃষকের মধ্যে চেতনা থাকতে হবে যে, আমি আত্মহত্যা করবো না। আমি আমার অধিকার আদায় করে নেবো। এজন্য চাহিদা তৈরি করতে হয়।

আমরা যারা কৃষকের অধিকার নিয়ে কাজ করছি, তাদের উচিত প্রান্তিক পর্যায়েও কৃষকদের নিয়ে সংগঠন করা, তাদের কাছাকাছি যাওয়া। এই দুটো না হলে সংকটের মীমাংসা হবে না। সরকারের তো মনিটরিং নেই। নলকূপ আছে কি না, পানির ঘাটতি কেমন, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে কি না- এসব নিয়ে তদারকি নেই। সরকার আইন লিখেই খালাস। বাস্তবায়ন নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

জাগো নিউজ: কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে কী বলবেন?
এম এম আকাশ: এখানে দুদিক থেকে ব্যর্থতা আছে। কৃষকরা নিজেরাই সচেতন নয়। অন্যদিকে যারা কৃষকদের সচেতন করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে, তারা তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা বিস্তৃত করতে পারেনি।

সাধারণত, মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী কর্মীরাই কৃষক সংগঠন করেন। মধ্যবিত্তরা আর আদর্শবাদী থাকছে না। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতিতে মধ্যবিত্তরাও। ষাটের দশকে একজন তাজুল ইসলামকে আমরা দেখেছিলাম, যিনি এমএ পাস করেও চাকরি না করে আদমজী পাটকলে গিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করার আন্দোলন করেছেন। এখন একজন তাজুল ইসলামকেও পাবেন না।

আদর্শবাদীদের আমি দোষ দিচ্ছি না। তারা হয়তো ভাবছে, এক সময় সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছি। সমাজতন্ত্র তো ব্যর্থ হয়েছে। আবার আদর্শবাদী হয়ে জীবন নষ্ট করবো? এই হতাশা থেকেই মানুষ আদর্শ থেকে সরে আছে। হতাশা দূর করতে হবে।

জাগো নিউজ: রাষ্ট্র, সমাজ যে জায়গায় চলে যাচ্ছে, সেখান থেকে হতাশা কাটানো আর সম্ভব?

এম এম আকাশ: রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বাণী ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাইও না। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো হলো পাপ’। সুতরাং, মধ্যবিত্তরা এগিয়ে না এলে প্রান্তিক মানুষেরাই আদর্শের জন্য লড়াই করবে। ক্ষেতমজুররাই এগিয়ে আসবে। তলা থেকে শুরু করতে হবে।

জাগো নিউজ: পরিবর্তনের কথা বললেন। এখন সেই পরিবর্তন (আদর্শচ্যুত) ত্বরান্বিত কি না?

এম এম আকাশ: সব জায়গায় এক রকম নয়। যেমন- গাইবান্ধায় আমাদের পার্টি থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০ হাজারের ওপরে ভোট পান। হয়তো বিজয়ী হতে পারছেন না। কিন্তু আদর্শের জন্য ২০ হাজার মানুষ তাকে সমর্থন করছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তো কেউ কেউ লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাগো নিউজ: সাধারণ প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই আন্দোলন-লড়াই তীব্র হওয়ার কথা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্তের পক্ষ থেকে।

এম এম আকাশ: এক সময় দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কমিটমেন্ট করে বামপন্থিরা সংগঠনকে বিস্তৃত করেছিল। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের দিকে আমরা এক ধরনের জোয়ার দেখেছিলাম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলো একদিকে চলে গেলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলো। এর মধ্যেও কিউবা ভেনিজুয়েলা, ভিয়েতনাম একরকম থেকে গেলো।

চীন আবার মিশ্র পদ্ধতি অবলম্বন করলো। চীন শ্রমজীবীদের অধিকার রক্ষা করছে। চায়নায় জমি জাতীয়করণ করা হয়েছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে জমি জাতীয়করণ করা হয়নি। চায়না জমি বণ্টন করছে তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। তৃণমূলে কমিউনিস্ট পার্টির, কৃষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে। তারা বসে ঠিক করছে যে, কোন পরিবারকে কত টাকা দেওয়া যাবে। পরিবারের লোক সংখ্যা বেশি হলে বেশি জমি পাচ্ছে, কম থাকলে কম পাচ্ছে। অথবা দরকষাকষি করে কৃষকরা জমি নিতে পারছে।

সমাজতন্ত্রের দুই ধরনের মডেল রয়েছে। এক, কেন্দ্রীভূত (আমলাতান্ত্রিক) মডেল, দুই, বিকেন্দ্রীভূত মডেল। বিকেন্দ্রীভূত মডেল এতই সফল হয়েছে যে, চীন এখন পৃথিবীতে শীর্ষ অর্থনৈতিক দেশে রূপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও আর চীনের সঙ্গে পারছে না।

বাংলাদেশে বামপন্থিরা নতুন চিন্তা করে না। নতুন চিন্তা জরুরি। নবায়িত সমাজতান্ত্রিক ধারণা নিয়ে বামপন্থিদের অগ্রসর হতে হবে।

জাগো নিউজ: নবায়িত সমাজতন্ত্র বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

এম এম আকাশ: যে সমাজতন্ত্র আমলাতান্ত্রিক বা কেন্দ্রভূত নয়, যে সমাজতন্ত্র বাজার ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় না, যে সমাজতন্ত্র বাজারকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রেখে, আমি নবায়িত সমাজতন্ত্র তাকে বোঝাতে চাইছি।

জাগো নিউজ: মূলধারার সমাজতন্ত্র আপনার এই ধারণাকে গ্রহণ করে?

এম এম আকাশ: ধারণা থেকে আলোচনা হতেই পারে। প্র্যাকটিস তো হতে পারে অন্তত। যেমন- চায়নাকে অনেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশ বলতে রাজি নয়। আমি মনে করি, চায়না সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। চায়না থেকে পজিটিভ বিষয়গুলো নিতে হবে, নেগেটিভ বিষয়গুলো বাদ দিতে হবে। চায়না আলীবাবা তৈরি করেছে। এখন আলীবাবা যদি চায়না দখল করে ফেলে, তাহলে কীসের সমাজতন্ত্র হলো? কিন্তু চায়না যদি আলীবাবার কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করে সব মানুষের কল্যাণে অসমতা কমাতে পারে, তাহলে সমস্যা কোথায়?

এএসএস/এএসএ/জেআইএম