ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

পাড়া-মহল্লার নতুন ‘বিপদ’ ব্যাটারিচালিত রিকশায় হাইড্রোলিক হর্ন

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৬:০৩ পিএম, ২৬ মে ২০২২

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের মুসলিম বাজার এলাকায় মায়ের দোয়া টেলিকমের স্বত্বাধিকারী এসহাক মিয়া মোবাইল ফোনে টাকা রিচার্জ বা টাকা পাঠাতে কাগজে নম্বর লেখেন না। গ্রাহকের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে নম্বর তুলতে বলেন। এটি করতে গিয়ে তার বেশ কয়েকটি ফোন চুরিও গেছে।

কাগজে কেন নম্বর লেখেন না, কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো তার দোকানটি বাজার সংলগ্ন। যেখানে প্রায় সবসময়ই শত শত ইলেকট্রিক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। যানবাহনের বিকট হর্নের কারণে স্পষ্ট করে কিছু শোনাও দুষ্কর হয়ে ওঠে।

এসহাক মিয়ার জবানিতেও এর সত্যতা মেলে। তিনি বলেন, এত শব্দ ঠিক করে কিছু শোনাও যায় না। কাস্টমার ‘ছয়’ বললে শুনি ‘নয়’। এভাবে অনেক কাস্টমারের সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছে। জরিমানাও দিয়েছি। এজন্য এখন কাস্টমারের হাতেই মোবাইল ফোন তুলে দিই। কিছু মোবাইল চুরি হলেও এটাতে ঝামেলা কম।

রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ বেশ কয়েকটি অভিজাত এলাকা বাদ দিলে অন্য প্রায় সব এলাকার অবস্থা এহসান মিয়ার মিরপুরের দোকান সংলগ্ন এলাকার মতো। হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকার অলিগলি। এসবের বিকট হাইড্রোলিক হর্ন কানে পীড়া দিচ্ছে শিশুসহ পথচারীদের। এলাকাবাসী বলছেন, ঘরের ভেতরে থেকেও নিস্তার নেই। রিকশার শব্দ কানে এসে বাজছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের হাইড্রোলিক হর্ন স্বাভাবিক হর্নের চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তিকর, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব ঢাকার পথঘাট। চালকরা বলছেন, দিনের বেলা মূল সড়কে চলাচল না করতে পারলেও রাত ৯টার পর তারা রিকশা নিয়ে মূল সড়কে ওঠেন। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেখলে আগে পুলিশ পথরোধ করলেও, এখন আর তেমন বাধার মুখে পড়তে হয় না তাদের। চালকদের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতেই রিকশায় হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছেন তারা। এসব হর্নের দামও নাগালের মধ্যে।

মনিপুর এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মেরাজুল জাগো নিউজকে বলেন, এখন যারা রিকশা চালায় তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ। দেখা যায় রাস্তায় অন্য কোনো যান বা মানুষ দেখলে আগেভাগে হর্ন দেয়। আবার চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয়। তখনও হর্ন ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ অকারণেও হর্ন দেন। তবে এ ধরনের হর্ন বিকট ও কানে লাগে বলে স্বীকার করেন এ রিকশাচালক।

jagonews24রিকশাচালকরা জানেন এই হাইড্রোলিক হর্ন এর ক্ষতিকর দিক- ছবি জাগো নিউজ

স্কুলশিক্ষিকা নওশাবা জাহাঙ্গীর বলেন, করোনার পর ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। চারতলায় বসেও এসব হর্নের বিকট শব্দ কানে আসে। রাস্তায় নেমে মাঝে মধ্যেই হাত দিয়ে কান বন্ধ করে রাখে। এসব হর্নে যে শুধু শব্দদূষণ হচ্ছে তা নয়, প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটছে। তবে যাত্রীদের অনেকে নিরূপায় হয়ে ওইসব রিকশায় চড়েই গন্তব্যে যাচ্ছেন।

ঢাকায় রিকশার সংখ্যা কত জানে না কেউ

ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে রজাধানীতে রিকশার সংখ্যা দুই লাখের বেশি। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার রাইটস বা বিলসের মতে, রাজধানীতে রিকশার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এ যানটি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় ২৪ লাখ মানুষ।

রিকশাচালক ও মালিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিকশার সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ১০-১২ লাখ। তবে এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক।

রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম জাগো নিউজকে বলেন, রিকশার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কারও কোনো সার্ভে নেই। আমাদের হিসাবে রাজধানীতে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। যার মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা। গত বছরের শেষ দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে পুলিশের ধরপাকড় চললেও এখন তা বন্ধ।

তিনি বলেন, গত চার-পাঁচ বছরে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। কিছু রিকশা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে, তবে সবাই তা করে না। রিকশাগুলোরও কারিগরি কিছু ত্রুটি আছে। সেটাও সমাধান করা সম্ভব, এজন্য বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) একটা মডেল আছে। সেটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে এবং সরকার কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলে এ যানকে নিরাপদ করা সম্ভব।

ব্যাটারিচালিত রিকশা কেমন শব্দ উৎপন্ন করছে

দীর্ঘদিন ধরেই কোন এলাকায় শব্দদূষণ কেমন তা পরিমাপ করে আসছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে দেশের ৬৪ জেলায় শব্দের মাত্রা পরিমাপ ও সচেতনতার কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন মহাসড়ক ও বাজারে যখন শব্দের পরিমাপ করি তখন দেখি অটোরিকশা টাইপের যানগুলো একধরনের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে। যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে শব্দদূষণ করে। আমরা লক্ষ্য করেছি, যেখানে মানুষজন নেই সেখানেও তারা হর্ন দেয়। এ ধরনের হর্নের লেভেল ৭০-৯০ ডেসিবেল হয়, যা ব্যক্তিগত গাড়ির হর্ন থেকেও প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি শব্দ উৎপন্ন করে। যা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, জেলা শহরগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার হাইড্রোলিক হর্নের শব্দদূষণ আমরা বেশি পাই। সেখানে ট্রাক কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কম। তবে রাজধানীতেও এখন প্রচুর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দেখতে পাচ্ছি।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালের আইন আছে। সে আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর ও ট্রাফিক পুলিশ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে। তবে এ বিষয়ে পরিবশে অধিদপ্তরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর শব্দদূষণের চিত্র কেমন

সম্প্রতি শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে আসে। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। যদিও এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় সবার ওপরে ওঠে আসে ঢাকার নাম।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। বাংলাদেশ সচিবালয়, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা  হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। যদিও ক্যাপাসের ২০২০ সালের সমীক্ষা বলছে, সচিবালয়সহ ঢাকার ১২টি স্থানের প্রতিটিতেই দিনের বেলায় শতভাগ সময় নীরব এলাকার জন্য প্রযোজ্য মানমাত্রার (৫০ ডেসিবেল) চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ রেকর্ড হচ্ছে। এসব স্থানে সম্মিলিতভাবে ৯১ দশমিক ৯৯ ভাগ সময় ৭০ ডেসিবেলের (তীব্রতর) বেশি মাত্রার শব্দ হয়।

jagonews24প্যাডেলচালিত রিকশার দেখা সহজে মেলে না-ছবি জাগো নিউজ

কী ধরনের ক্ষতি এই হাইড্রোলিক হর্নে

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার হর্ন শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতিসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের বিস্তার করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এ ধরনের শব্দদূষণের ফলে হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। মাথা ব্যথা, শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনের সমস্যা, মানসিক অশান্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত শব্দের কারণে মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শ্রবণশক্তি কমে যায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকায় মৃদু বধির বা শ্রবণশক্তি কমে গেছে এমন লোকের সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি বলেন, বদ্ধ ঘরেও এখন মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে, সে নিজে যেহেতু কম শুনতে পায় এ কারণে সে জোরে কথা বলে। আমরা দ্রুত বিরক্ত ও উত্তেজিত হই। ফলে শরীরে কতগুলো হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা হার্টবিট ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।

অতি উত্তেজনার কারণে আমাদের ঘুম কমে যায়। মনোযোগও কমে। একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়- জানান এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি এ ধরনের গাড়ি আমদানি, ক্রয়-বিক্রয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবে এ নির্দেশনা রয়ে গেছে কাগজে-কলমেই। এর আগেও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

এরপর ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনো আদেশ না এলেও ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল আপিল বিভাগ আদেশ দেন মহাসড়ক নয় সড়কে  চলবে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার।

এর আগে ব্যাটারিচালিত অবৈধ ইজিবাইক (থ্রি-হুইলার) চিহ্নিত করে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের দেওয়া ওই আদেশ সংশোধন করে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সংশোধিত আদেশে ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলার হাইওয়েতে চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে সড়ক থেকে সরানোর যে নির্দেশ আগে ছিল সেটি সংশোধন করে শুধু মহাসড়ক থেকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে থ্রি-হুইলার আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয়ের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেন আদালত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলিগলিতে ইজিবাইকের দাপট বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এখন ব্যাপকহারে চলাচল শুরু করেছে ব্যাটারিচালিত রিকশাও। তারা বেপরোয়াভাবে হাইড্রোলিক হর্নও ব্যবহার করছে। এগুলোর ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এসএম/এমকেআর/জিকেএস