নাটক-ওয়াজ-সিনেমা নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে: গবেষণা
টিকটক-লাইকির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলামেলাভাবে নিজেকে উপস্থাপন, খোলামেলা পোশাক পরা, অশালীন আচরণ, খারাপ ভাষা ব্যবহার, গণমাধ্যম বা টিভিতে কাজ করা নারীদের ‘মন্দ মেয়ে’ বলছে সমাজের একটি অংশ। তাদের অধিকাংশ মনে করছে, এ ধরনের মেয়েরা নানাভাবে হেয় অথবা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হন।
অন্যদিকে যারা ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলেন তারা ‘ভালো মেয়ে’ বলে মনে করেন সমাজের অর্ধেকের বেশি মানুষ। এছাড়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট ও পর্নোগ্রাফি বেশি দেখেন কিশোর, যুবক এবং পরিণত পুরুষরা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটি দাবি করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।
ডেস্ক রিসার্চ, অনলাইন রিসার্চ, হাইপোথিসিস, সার্ভে, বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে আটটি বিভাগের ১৬ জেলায়। বিভিন্ন ধরনের ক্লাস্টার থেকে স্যাম্পল নেওয়া হয়েছে মোট ৫১৮ জনের। প্রতি সেন্টার থেকে ৩০ জন, গ্রাম ও শহর ৫০ শতাংশ করে নারী ও পুরুষ ৫০ শতাংশ করে স্যাম্পল ধরা হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের ৫১৮ জন এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন। তবে গবেষণায় পর্নোগ্রাফি, সেক্সসিজম নিয়ে কাজ করা কঠিন ছিল বলে দাবি করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, সমাজে যৌন হয়রানি ও নারীবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু টিভি নাটক, সিরিয়াল, ওয়াজ ও বাংলা সিনেমা। ২০২১ সালের অক্টোবর মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এ গবেষণা করা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৮১ জন মনে করেন ‘মন্দ মেয়েদে’র নানাভাবে হেয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়। এমন মেয়ের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে শতকরা ৭১ জন পথচারী। সমাজে ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ মেয়ে আছে এটা বিশ্বাস করেন শতকরা ৭৯ জন।
অপরদিকে শতকরা ৫২ জন মানুষ মনে করেন, মেয়েদের সিনেমায় কাজ, পুরুষের সঙ্গে রাতের শিফটে কাজ বা দূরে একসঙ্গে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক নয়। এর মধ্যে শতকরা ২১ জন নারী ও ৩১ জন পুরুষ।
অন্যদিকে যারা ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলেন তারা ‘ভালো মেয়ে’ বলে মনে করেন গবেষণায় অংশ নেওয়া শতকরা ৬৬ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মন্দ’ মেয়ের মতো আচরণ সমাজের অন্য ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করে বলে মনে করেন শতকরা ৭৯ জন মানুষ। তাই অনলাইনে ‘মন্দ মেয়ে’র মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখতে হেয় বা অপমান করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা।
গবেষণা বলছে, মেয়েদের ভালো হতে উৎসাহী করা ও মন্দ বিষয়ে বাধা দেওয়া এবং তাদের নিরাপদে রাখা পুরুষের দায়িত্ব-এটা মনে করেন শতকরা ৮০ ভাগ উত্তরদাতা। এর মধ্যে নারী উত্তরদাতা ছিলেন ৩৫ শতাংশ।
এছাড়া বেশি সংখ্যক কিশোর, যুবক ও পরিণত পুরুষ নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট নিয়মিত দেখেন বলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮১ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বেড়েছে বলে মনে করেন শতকরা ৮২ জন। এরমধ্যে শতকরা ৪০ জন নারী ও পুরুষ রয়েছেন ৪২ জন।
মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার
গবেষণায় দেখা গেছে, ছেলেদের থেকে মেয়েরা কিছুটা বেশি ব্যবহার করে মোবাইল-ইন্টারনেট। এর মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহারের হার অনেক বেশি।
শতকরা ৫১ জন ছেলে ফেসবুক ব্যবহার করে, আর শতকরা ৩৯ নারী ব্যবহার করে ফেসবুক। এরপরই আছে ইমো, যা ছেলেরা শতকরা ২৯ ভাগ এবং মেয়েরা শতকরা ২০ ভাগ ব্যবহার করে।
এছাড়া টিকটক, লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মতো মাধ্যম মেয়েদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এমনটা মনে করেন শতকরা ৮৩ জন উত্তরদাতা। এরমধ্যে পুরুষ শতকরা ৪৫ ভাগ এবং নারী শতকরা ৩৮ ভাগ। অনলাইনে মন্দ কনটেন্ট যেমন এডাল্ট মুভি, পর্নোগ্রাফি শতকরা ৭৫ জন ছেলেরা দেখে থাকে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে শতকরা ৩৮ জন নারী ও ৩৭ ভাগ পুরুষ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেসব মেয়েরা ধর্ষণের শিকার বা যৌন হেনস্তার শিকার হর, তাদের নিজেদেরও দোষ আছে- এটা ভাবে শতকরা ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা। শতকরা ৭৩ জন মনে করেন যে একটি মেয়ের জীবন তখনই সফল হয়, যখন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শতকরা ৬৩ জন মনে করেন মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দিলে তারা পুরুষকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে এবং শতকরা ৫৮ জন মনে করেন মেয়েরা প্রায়ই ছেলেদের নির্দোষ আচরণকেও নির্যাতন মনে করে।
অনুষ্ঠানে ডি-নেটের ইনোভেশন অ্যাডভাইজার সিরাজুল ইসলাম বলেন, পর্নোগ্রাফি দেখার হার বাড়ার ফলে সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংসতাও বেড়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ৮২ ভাগ মানুষই মনে করেন, সহিংসতা বেড়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, পর্নোগ্রাফি সাইট বন্ধ করেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। নারীকে সম্মান করা, মূল্যবোধের বিষয়টি শিশুকে পরিবার থেকেই শেখাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন, পর্নোগ্রাফি দেখে কেউ সহিংসতা করেছে তা আইনের মাধ্যমে প্রমাণ করা কঠিন। স্বামী পর্নোগ্রাফি দেখে স্ত্রীকে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ করলেও তা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, সমাজে ধর্ষণ বেড়েছে, একই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারী বিচার পাচ্ছেন না, ধর্ষকেরাও পার পেয়ে যাচ্ছে।
এসএম/জেডএইচ