পেটের ‘ইয়াবা’ বের করতে শাহজাহানকে ওষুধ খাইয়ে মারে ঘাতকরা
গত ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর খালে পাওয়া যায় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের মরদেহ। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশ হয়ে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
তার কয়েকদিন আগে ২ অক্টোবর পাশের পটিয়া উপজেলা থেকে নিখোঁজ হন মো. শাহজাহান আলম বালু (৩৮) নামে এক ব্যক্তি। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচর গ্রামের নূর হোসেন মেম্বারের ছেলে। শাহজাহান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পটিয়া থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন তার ভাই জাহাঙ্গীর আলম। এ মামলায় পুলিশ তিন আসামিকে গ্রেফতার করে। তবে তাদের গ্রেফতারের পরও রহস্যের কোনো কূল-কিনারা হচ্ছিল না।
এদিকে বোয়ালখালী থানায় দায়ের হওয়া মামলারও খুলছিল না জট। শেষমেশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে এই মামলার তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট তদন্তভার পাওয়ার কয়েকমাস পর নিহত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত হয়। জানা যায়, পটিয়া থেকে নিখোঁজ হওয়া সেই শাহজাহানেরই মরদেহ এটি।
তার পরিচয় শনাক্তের পর পিবিআইয়ের তদন্তে গতি আসে। সঙ্গে সঙ্গে পটিয়া থানায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাতেও খুলছিল না রহস্যের জট। তবে একই সময়ে খুন হওয়া যুবক শাহজাহানের স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তাদের মুখ দিয়ে ক্লু বের করার চেষ্টা চলে।
একপর্যায়ে শাহজাহানের এক স্বজন জানান, অপহরণের দিন রাতে তার মোবাইলে একটি কল এসেছিল। এই তথ্য পাওয়ার পর প্রযুক্তিতে ভর করে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হয়। কল পাওয়ার স্থান পরিদর্শন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে নিয়োগ করা হয় সোর্স।
পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার দুই আসামি
নানা সমীকরণ মিলিয়ে পটিয়া উপজেলা থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় দুই যুবককে। তারা হলেন- মো. সাইফুল ইসলাম (৪০) ও মেহেদী হাসান ওরফে হিরু (২৭)। তারা দুজনই পটিয়ার দক্ষিণ ভুর্ষি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে সাইফুলের বাবার নাম মৃত নুরুল আলম এবং মেহেদীর বাবার নাম আবু ছিদ্দিক।
গ্রেফতারের পর দুই যুবককে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দুজনেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।
এরপর রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুই আসামিকে নিয়ে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং আলামত জব্দের জন্য পটিয়া এলাকায় যায় পিবিআইয়ের একটি টিম। তাদের নিয়ে উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের খানমোহনা গ্রামের মহিষপাড়া এলাকার হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করা হয়।
এ সময় আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পটিয়ার খানমোহনা পশ্চিম বিলে নুরুর মহিষ রাখার পরিত্যক্ত ঘরের পাশ থেকে ভুক্তভোগীকে মারধরে ব্যবহৃত তিনটি গাছের লাঠি ও একটি পিভিসি পুরাতন পাইপ জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে বেশ কিছু সিরাপ এবং ট্যাবলেট জব্দ করা হয়, যেগুলো ভুক্তভোগীকে খাওয়ানো হয়েছিল।
ঘটনার বিষয়ে পিবিআই সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে মহিউদ্দিন ও সুজন নামে দুজন বিয়ের ভিডিও প্রোগ্রাম শেষ করে খানমোহনা এলাকায় দোকানে যাচ্ছিলেন। একই সময়ে রেলস্টেশনের পাশে আমির ভান্ডার দরবার থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন শাহজাহান। এ সময় শাহজাহানের সঙ্গে মহিউদ্দিন ও সুজনের সাক্ষাৎ হয়। শাহজাহানকে ইয়াবা ব্যবসায়ী সন্দেহ করে দুজনে গতিরোধ করেন। এরপর দুজনে মিলে শাহজাহানকে খানমোহনা পশ্চিম বিলে নুরুর মহিষ রাখার পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে যান।
আলামত সংগ্রহে হত্যাকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করে পিবিআই টিম
সেখানে নিয়ে তারা সাইফুল ও মেহেদী হাসানসহ আরও কয়েকজনকে ডাকেন। তারা সবাই মিলে শাহজানের পেটে ইয়াবা আছে বলে মারধর করতে থাকেন। কিন্তু তাতেও ইয়াবা পাওয়া না যাওয়ায় একপর্যায়ে ওষুধের দোকান থেকে পায়খানা হওয়ার ট্যাবলেট আনা হয়। ট্যাবলেট প্রথমে এক ডোজ খাওয়ানোর পর শাহজাহান দুইবার পায়খানা করেন। কিন্তু ইয়াবা ট্যাবলেট বের না হওয়ায় দুই ঘণ্টা পর ঘাতকরা পরামর্শ করে পুনরায় পায়খানা হওয়ার ট্যাবলেট খাওয়ান শাহজাহানকে। এরপর ভুক্তভোগী আবার পায়খানা করেন। কিন্তু তাতেও বের হয়নি ইয়াবা।
এবার ফার্মেসি থেকে আনা হয় সিরাপ। সিরাপ খাওয়ানোর পর লাগাতার পায়খানা করতে থাকেন শাহজাহান। একপর্যায়ে শাহজাহানের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিনি পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকেন। পানি খাওয়ানোর জন্য শাহজাহানকে হত্যাকারীরা পার্শ্ববর্তী চাঁনখালী খালে নিয়ে যান। তবে শাহজাহান এমন নিস্তেজ হয়ে পড়েন যে, খালে গিয়ে তিনি আর পানি পান করতে পারেননি। এরপর শাহজাহানের অবস্থা খারাপ দেখে ঘাতকরা তাকে খালে ফেলে চলে আসেন। তার দেহ ভাসতে ভাসতে বোয়ালখালী চলে যায়।
ঘটনার তিন দিন পর ওই বছরের ৫ অক্টোবর বোয়ালখালীর সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচরে রায়খালী খালে মাঝির ব্রিজের নিচে শাহজাহানের মরদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা থানায় ফোন দেন। পরে পুলিশ এসে মরদেহটি নিয়ে যায়।
পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের সুপার নাজমুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২০ সালের ২ অক্টোবর রাতে শাহজাহান পটিয়ার আমির ভান্ডার দরবার শরিফ জিয়ারতের জন্য বাড়ি থেকে বের হন। জিয়ারত শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তুলে নিয়ে অভিনব কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করে। একই ঘটনায় পটিয়া থানায় অপহরণ এবং বোয়ালখালী থানায় হত্যা মামলা হয়েছিল। হত্যা মামলাটি তদন্তের সূত্র ধরে দুটি মামলার জটই খুলেছে। এ ঘটনায় দুজন আসামি গ্রেফতার হয়েছেন। জড়িত বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
মিজানুর রহমান/এইচএ/জেআইএম
সর্বশেষ - জাতীয়
- ১ একাত্তরের অমীমাংসিত সমস্যা মীমাংসা করুন: শেহবাজ শরিফকে ড. ইউনূস
- ২ গ্রাহক সেজে ব্যাংকে ঢোকেন ডাকাতরা, খেলনা পিস্তল ঠেকান ম্যানেজারকে
- ৩ উদ্ধার হওয়া ৪ অস্ত্র আসল নয়, খেলনা পিস্তল
- ৪ ডাকাতদের বয়স ২১-৩০, এখনো বের হননি জিম্মি ব্যাংক কর্মকর্তারা
- ৫ হজযাত্রী সমন্বয় ও লিড এজেন্সি নির্ধারণের সময় বেঁধে দিল মন্ত্রণালয়