শয্যা খালি নেই, শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী সামলাতে হিমশিম
দেশে করোনা সংক্রমণ ক্রমে নিম্নমুখী হলেও ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এডিস মশাবাহিত এ রোগে তুলনামূলকভাবে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুরো আক্রান্ত গীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। শয্যা খালি না থাকায় নতুন রোগীদের ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে তিন মাসের শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের তিনতলায় ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি তিন মাস ১০ দিন বয়সী শিশু মুন তাহা। গত সাতদিন আগে তার জ্বর আসে। এতে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তিনদিন আগে ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় এনে তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মুন তাহার বাবা আরিফুর জামান জাগো নিউজকে বলেন, কীভাবে যে মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো, বুঝতে পারছি না। এলাকার কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা নেই। মেয়ের অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ায় তাকে তিনদিন আগে এ হাসপাতালে এনে ভর্তি করেছি। এখন তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।
পাশের বেডে ভর্তি মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা থেকে আসা সাত মাসের শিশু ইয়া হায়দার। অবিরাম কান্না করে যাচ্ছে। মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও কাজ হচ্ছে না। গত ৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে শিশুটির গায়ে জ্বর আসে। এলাকার একটি ক্লিনিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ালেও লাভ হয়নি। দুদিন পর ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিশু হাসপাতালে এনে ডাক্তার দেখালে পরীক্ষা করার পর ১১ সেপ্টেম্বর রিপোর্টে শিশুটির ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ওইদিনই তাকে হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
শিশুটির মা লিজা আক্তার জাগো নিউজকে জানান, দুই সপ্তাহ ধরে মেয়েটি অনেক অসুস্থ। গত ৬ সেপ্টেম্বর ওর পিঠে একটি মশার কামড়ে দাগ বসে যায়, পরদিন থেকেই জ্বর। কিছুক্ষণ পরপর ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর আসছে। এ কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্তের প্ল্যাটিনেট অনেক কমে যাওয়ায় তাকে রক্তও দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মিরপুর-১৪ নম্বরে পাঁচতলা একটি বাড়ির নিচতলায় তাদের পরিবার ভাড়া থাকে। বাড়ির ভেতরের অংশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও বাইরে ময়লা-আর্বজনা। সেখানেই মশা বিস্তার হয়। চিকিৎসা চললেও মেয়েটা কিছু খেতে পারে না। দিনভর কান্না করে। গত দুই সপ্তাহে এ পর্যন্ত শিশুটির চিকিৎসা করাতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কবে তার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে আর কত টাকা প্রয়োজন হবে, তা এখনো তাদের জানা নেই।
মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা মৌসুমি বেগম। গত ৪ সেপ্টেম্বর ১০ বছরের ছেলে মাহিনকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সাতদিন তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। তিনদিন ধরে তাকে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সে সুস্থ হয়ে উঠছে।
মৌসুমি বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। গত ২ সেপ্টেম্বর ওর জ্বর এলে শিশু হাসপাতালে এনে ডাক্তার দেখানো হয়। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে তার পেটে ব্যথা, কাশি, হাঁটু ব্যথা, মাথা ব্যথা, জ্বরসহ শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তির পর এক সপ্তাহ তাকে আইসিইউতে রাখার পর বেডে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, বাসার আশপাশে ময়লা ও জমাট পানি থাকায় সেখানে এডিস মশা জন্মায়। সেসব মশা বাড়ির মধ্যে এসে কামড়ায়। এভাবেই তার সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের পার্শ্ববর্তী বাসাগুলোর অনেক শিশুও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকার সবুজবাগের বাসিন্দা আসাদুজ্জামানের দুই ছেলে একসঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ বছর বয়সের বড় ছেলে ওমর ফারুক সুস্থ হলেও এক বছর বয়সের ছোট ছেলের জ্বর কমছে না। কিছুক্ষণ পরপর শরীরে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসছে। কিছুই খেতে পারছে না, শুধু কান্না করছে। সন্তানদের চিন্তায় পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের ঘুম হারাম।
আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ছোট ছেলেকে নিয়ে অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ওর চিকিৎসা চললেও এখনো সুস্থ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর জ্বর আসছে, ঘুমাতে পারছে না। দুই ছেলের একসঙ্গে ডেঙ্গু ধরা পড়লেও বড় ছেলেটা ভালো হয়েছে। ছোট ছেলেকে নানা ধরনের ওষুধ দেওয়া হলেও সে এখনও সুস্থ হচ্ছে না।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে থেকে জানা গেছে, এ হাসপাতালে মোট ৬৩০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। গত সাতদিনে ৮৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গু ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন বেডে ৬২ জন ভর্তি রয়েছে। আইসিইউতে রয়েছে চারজন। এ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই মিরপুরের বাসিন্দা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বুধবার জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন যে পরিমাণে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হতে আসছে, আমরা সবাইকে ভর্তি করতে পারছি না। হাসপাতালের সব শয্যায় রোগী ভর্তি থাকায় নতুন রোগীর জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে আমাদের চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি বলেন, একদিকে করোনা তার ওপর ডেঙ্গু মহামারিতে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যার যার বাসার আশপাশ নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বৃষ্টি যত দিন থাকবে, ডেঙ্গুর প্রকোপও থাকবে।
এমএইচএম/এমকেআর/জিকেএস