উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি, সুপারিশ থাকলেও বাস্তবায়ন নেই
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধে সরকার ঘোষিত লকডাউনের পর যান্ত্রিক নগরখ্যাত ঢাকা পুরোনো রূপে ফিরে এসেছে। দীর্ঘসময় লকডাউন চলাকালে সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, সব ধরনের গণপরিবহন, মার্কেট-শপিংমল, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও গত ১১ আগস্ট থেকে সব খুলে দেয়া হয়েছে। জীবন-জীবিকার সন্ধানে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে।
এক মাসের বেশি সময় লকডাউনের সুফল হিসেবে আগের তুলনায় করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমেছে। তবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভায় সংক্রমণ ও মৃত্যু পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। জাতীয় কারিগরি কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সরকার সব খুলে দিতে বাধ্য হলেও সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরিধানসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলা) আবশ্যিকভাবে মেনে চলতে হবে। অন্যথায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো দায় হয়ে পড়বে।
মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে সড়ক ও মহাসড়ক সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জাতীয় কারিগরি কমিটির সুপারিশ কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। তাদের সুপারিশ তথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো সংস্থা নেই। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি অহরহ উপেক্ষিত হচ্ছে। গত বছর লকডাউনের পর গণপরিবহনগুলোতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা গেছে। বাসের চালক ও হেলপারের মুখে মাস্ক ও বাসে ওঠার আগে স্যানিটাইজার স্প্রে করা হলেও গত ১১ আগস্ট লকডাউন শেষে গণপরিবহন চালু হলেও অধিকাংশ বাসের হেলপার ও চালকের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। স্যানিটাইজারের বোতল হাতেও কাউকে স্প্রে করতে দেখা যায় না। অধিকাংশ বাসের চালক ও হেলপারের মাস্ক মুখে থাকছে না। কানের পাশে কিংবা থুতনির নিচে ঝুলতে দেখা গেছে। কোনো কোনো বাসে চালকদের ধূমপানের দৃশ্যও চোখে পড়েছে।
গত ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত (১৭ থেকে ২২ জুলাই পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচল করে) লকডাউন চলাকালে ট্রাফিক পুলিশকে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের কাগজপত্র তল্লাশির পাশাপাশি জনসাধারণকে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে দেখা গেলেও বর্তমানে পুলিশ কর্মকর্তারা মামলা নিয়েই ব্যস্ত। অনেক সময় গাড়ির চালকরা মাস্ক ছাড়াই ট্রাফিক পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে গত এক সপ্তাহে করোনার নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থ রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছরের করোনা সংক্রমণের ইপিডেমিওলজিক্যাল ৩১তম সপ্তাহে (২ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত) রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে মোট তিন লাখ ২৬ হাজার ৯৮৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। একই সময়ে পরীক্ষায় আক্রান্ত হিসেবে ৮৯ হাজার ৩৬৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এছাড়া সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ১২ হাজার ১৮১ ও মারা গেছেন এক হাজার ৭৩৬ জন।
অন্যদিকে ৩২তম সপ্তাহে (৯ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত) দুই লাখ ৯১ হাজার ১১১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে নতুন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন ৬৫ হাজার ২০৭ জন। একই সময়ে সুস্থ হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৫১ ও মারা গেছেন এক হাজার ৫২৩ জন।
এই দুই সপ্তাহের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থতা ও মৃত্যুহার কমেছে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, ২২ দশমিক ২২ শতাংশ ও ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম করোনা পরিস্থিতি সংক্রান্ত ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন,‘লকডাউনের সুফল হিসেবে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা কিছুটা কমলেও শতভাগ মানুষ মুখে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মেনে না চললে ফের সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এমইউ/ইএ/এমকেএইচ