বিধিনিষেধের প্রথম দিনে ফাঁকা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে ঈদুল আজহার পর সরকারঘোষিত লকডাউনের (বিধিনিষেধ) প্রথম দিনেই অনেকটা ফাঁকা দেখা গেছে অন্যতম ব্যস্ততম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে। ভোরে দূরপাল্লার কয়েকটি বাস চলাচল করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে থেমে কয়েকটি পণ্যবাহী গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টমটম ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা গেছে। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল।
শুক্রবার (২৩ জুলাই) সরেজমিন সড়কটির কেরানিহাট, ঠাকুরদিঘি ও লোহাগাড়া এলাকায় ঘুরে তেমন কোনো লোকজনের দেখা মেলেনি।
কয়েকজন অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের পর এমনিতে ছুটির দিন হওয়ায় সড়কে তেমন লোকজনের উপস্থিতি নেই। অন্যান্য সময়ের লকডাউনে এসব এলাকায় দোকানপাট খোলা থাকলেও আজ বন্ধ বেশিরভাগ দোকান। বাড়িতে কোরবানির মাংস থাকায় লোকজন বাজার করতেও কম বের হয়েছেন। তবে হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে বের হয়েছেন কিছু লোকজন।
কেরানিহাট মোড়ে আসা আলমগীর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি অটোরিকশা পেয়েছি। কিন্তু গাড়িচালক স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ভাড়া নিয়েছেন। অন্যান্য সময় আমার বাড়ি ঠাকুরদিঘি এলাকা থেকে কেরানিহাট আসতে ভাড়া ১০০ টাকা নিলেও আজ নিয়েছেন ১৮০ টাকা। কি আর করব? আমাদের তো বাধ্য হয়ে আসতে হচ্ছে।’
জানতে চাইলে অটোরিকশার চালকের আসনে থাকা মো. হাসান বলেন, ‘আমরা অনেকটা চুরি করে গাড়ি বের করেছি। পুলিশ ধরলে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা নিয়ে নেয়। গত লকডাউনে একবার ধরছিল ছয় হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছি। রিস্ক নিয়ে গাড়ি বের করেছি। তা ছাড়া ট্রিপও আগের মতো মারতে পারি না। তাই ভাড়া একটু বেশি নিতে হচ্ছে।’
বিধিনিষেধের মধ্যে গাড়ি বের করেছেন কেন- জানতে চাইলে অটোরিকশা চালক হাসান বলেন, ‘পেট তো আর বিধিনিষেধ মানছে না। টাকা নেই বাড়িতে। আবার গাড়ি কিনতে ঋণ নিছিলাম। সপ্তাহ শেষে কিস্তির টাকাও দিতে হবে। তাই বের হয়ে কিছু টাকা পাই কি-না দেখছি।’
সাতকানিয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সকাল থেকে থানার তিনটি টিম মাঠে নেমে কাজ করছে। সড়কে বিনা কারণে কোনো গাড়ি বা কোনো ব্যক্তি বের হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় জনসমাগমের বিষয়টিও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারি নির্দেশনায় পবিত্র ঈদুল আজহার পর আজ (শুক্রবার) সকাল থেকে ফের ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ বিধিনিষেধ চলবে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
বিধিনিষেধ ঘোষণার পর সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এবারের বিধিনিষেধ চলাকালে পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্পকারখানা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জরুরি সেবা, গণমাধ্যম ও খাদ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহনও বন্ধ থাকবে। অবশ্য এই কঠোর বিধিনিষেধের আওতার বাইরে থাকবে কোরবানির পশুর চামড়া সংশ্লিষ্ট খাত, খাদ্যপণ্য এবং কোভিড-১৯ প্রতিরোধে পণ্য ও ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান।
বিশেষ করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট (বিদেশগামী যাত্রী পরিবহনের জন্য শর্তসাপেক্ষে তিনটি এয়ারলাইন্স ছাড়া) বন্ধ থাকবে। রাজধানী ঢাকা থাকবে বিচ্ছিন্ন। জিরো টলারেন্সে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
\
গত ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে কঠোর বিধিনিষেধে যে ২৩ নির্দেশনা মানতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো :
১. সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
২. সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
৪. সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে।
৫. সব প্রকার শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকবে।
৬. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৭. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতসমূহের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
৮. ব্যাংকিং/বীমা/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
৯. সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাফতরিক কাজ ভার্চুয়ালি (ই-নথি, ই-টেন্ডারিং, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যম) সম্পন্ন করবেন।
১০. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন/বিক্রয়, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রম, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রম), সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের কর্মচারি ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে।
১১. বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
১২. জরুরি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ড ভ্যান/নৌযান/পণ্যবাহী রেল/ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
১৩. বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
১৪. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
১৫. অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৬. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।
১৭. খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
১৮. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট/প্রমাণক প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।
১৯. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
২০. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
২১. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি/কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
২২. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
২৩. ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
মিজানুর রহমান/এমআরআর/জিকেএস