চট্টগ্রাম থেকে বদলি হওয়া দুদক কর্মকর্তা শরীফের যত অভিযান
সপ্তাহখানেক বেশ আলোচনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম-২ জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। একের পর এক দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করে আলোচনায় আসেন তিনি। তার তদন্তে ধরা পড়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও দালাল।
এর মধ্যে বুধবার (১৬ জুন) দুদকের প্রধান কার্যালয়ের এক চিঠিতে চট্টগ্রামের কার্যক্রম থামাতে হয়েছে তাকে। গতকালের ওই চিঠিতে তাকে পটুয়াখালী জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
কেউ কেউ বলছেন, দুর্নীতিবিরোধী বড় বড় অভিযান চলাকালে হঠাৎ তার বদলির আদেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার বদলির পাশাপাশি তাকেও চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয়েছে। যদিও দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এটি তাদের নিয়মিত বদলির অংশ।
চট্টগ্রামে শরীফের যত অভিযান
দুদকের এই কর্মকর্তা চট্টগ্রামে গত ১০ জুন সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানকে ২২টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানের দায়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের (কেজিডিসিএল) ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ট্রান্সমিশন ডিপার্টমেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেফতার করেন। পরে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মন্ত্রীপুত্র মুজিবুরকেও আসামি করা হয়।
এরপর ১৩ জুন শরীফের তথ্যে অবৈধ সম্পদ গোপনের দায়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)পূর্ত কর্মের পরিচালক এসএমএ আজিম (৫৬) ও তার স্ত্রী নবতারা নুপুরের (৪৭) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
দুইদিন পর ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্মসনদ, জাতীয়তা সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান এবং পাসপোর্ট আবেদন করতে সহায়তা করার দায়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নুরুল আবছার, ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. নুরুল ইসলাম, জন্ম নিবন্ধন প্রস্তুতকারী মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন এবং হাটহাজারী ও চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের চার কর্মচারী ও চার রোহিঙ্গাসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শরীফ।
একই দিন শরীফের দেয়া তথ্যে এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগে চসিকের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেল, ওই ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী মো. ফরহাদ হোসাইন, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ও তিন কর্মচারীসহ মোট ছয়জনকে আসামি মামলা দায়ের করা হয়।
গত বুধবার (১৬ জুন) রােহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভােটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির অভিযোগে চট্টগ্রামের সাবেক সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক খােরশেদ আলম, চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের তিন কর্মচারী মাহফুজুল ইসলাম, রাসেল বড়ুয়া ও মাে. মােস্তফা ফারুকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শরীফ।
একইদিন (বুধবার) শরীফের দেয়া তথ্যে দুই রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের তিন কর্মচারীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এছাড়া এ বছরের শুরুতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় অনিয়মের দায়ে একজন দালাল ও সাবেক একজন সার্ভেয়ারকে গ্রেফতার করেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ।
এরপর তার তদন্তে ধরা পড়ে কক্সবাজারের কলাতলী মোড় এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অফিস তৈরির জন্য এক একর (১০০ শতক) জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি। এ ঘটনায় প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হয়।
এ বছরের মার্চে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের খালাসি পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
এসব অভিযান চালিয়ে আলোচনায় থাকা মো. শরীফ উদ্দিনের বদলি আদেশের চিঠি আসে গত বুধবার (১৬ জুন)। দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই আদেশে শরীফসহ মোট ২১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। একই আদেশে বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের ১ জুলাইয়ের মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হতে বলা হয়।
যা বলছেন সুধীজনরা
মো. শরীফ উদ্দিনের বদলির বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় তার বদলি আদেশ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার বদলি যদি স্বাভাবিকও হয়, এ সময়ে বদলি করা একেবারে উচিত হয়নি। এতে করে কর্মকর্তাদের মনোবলে আঘাত লাগে।’
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও কলাম লেখক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের মধ্যে সাধারণত একটি অদৃশ্য সরকার থাকে যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যদি দুদক কর্মকর্তা শরীফের বদলি সরকার ও প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণে হয়ে থাকে, তবে আমি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করি। আবার সরকারি চাকরিতে বদলি হচ্ছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সুতারাং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তার বদলিও হতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কক্সবাজারে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং রাজনীতিবিদ ও দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় তার এই বদলি আদেশ হতে পারে। এছাড়া চট্টগ্রামে সপ্তাহখানেক ধরে তিনি বেশ সক্রিয় অভিযান পরিচালনা করছিলেন। বিশেষ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে অভিযান চালানোটা তার কাল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বদলি হওয়া দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কাজের গতি আনার জন্য এ বদলি : দুদক চেয়ারম্যান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আড়াই-তিনবছর হলে একজন কর্মকর্তাকে বদলি করি। এটি আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। কাজের গতি আনার জন্য এ ধরনের বদলি।’
তিনি বলেন, ‘শুধু শরীফকে না, আরও ২০ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। আপনারা শুধু তার বিষয়ে বলছেন কেন? শরীফ ভালো অফিসার, তিনি নতুন কর্মস্থলেও ভালো কাজ করবেন বলে আশা করছি। অভিযানের ক্ষেত্রে আসলে শরীফের একার তো করার কিছু নেই। তার করা মামলাগুলো আমরা অনুমোদন দিয়েছি। আমরা অনুমোদন না দিলে তিনি কি অভিযান পরিচালনা করতে পারতেন?’
এই বদলিতে অভিযান পরিচালনা করা কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে কি-না, প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘মনোবল ভেঙে পড়বে না। বরং নতুন কর্মস্থলে তারা উৎসাহ নিয়ে কাজ করবেন।’
মিজানুর রহমান/এমএইচআর/এইচএ/জেআইএম