বিধিনিষেধ : মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আচরণে ‘স্বার্থপরতা’
‘মানুষ দায়িত্বহীন আচরণ করছে বলেই তো সমাজের এই অবনতি। সবাই যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার সহযোগী হতে চায় না কেউ-ই। অথচ এভাবে কেউ বাঁচতে পারে না। এখন তাই হচ্ছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটল খুব স্বার্থপরভাবে। এই চিত্র সামগ্রিকভাবেই দেখতে পাচ্ছি। করোনাকাল আরও স্পষ্ট করে গেল এই পরিবর্তন।’
বলছিলেন লেখক, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক এবং এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিত এলাকা ছেড়ে মানুষের অন্যত্র চলে যাওয়া এবং ব্যক্তিপর্যায়ের সচেতনতার প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে ছড়ানো করোনার বিষ এখনো মানুষ মারছে। গোটা বিশ্বই করোনার থাবায় বিপর্যস্ত। একটি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে মানব সভ্যতার অসহায়ত্বের এমন নজির ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত কৌশলও সঠিক সমাধানের পথ দেখাতে পারেনি আজ পর্যন্ত। তাই দেশ বা অঞ্চলভেদে নানা উদ্যোগ নিতে হচ্ছে মহামারির কবল থেকে সুরক্ষা পেতে। মহাবিপর্যয় ঠেকাতে লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপও নিতে হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোকে।
বাংলাদেশেও এমন বিধিনিষেধ নিতে দেখা গেছে। মহামারির শুরুতে ২০২০ সালে যে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিল, তা সময়ের ব্যবধানে শিথিল করা হয়েছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদেই নমনীয়তা দেখাতে হয়েছে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ২০২১ সালে ফের লকডাউনে যেতে হয়েছে। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে গত ঈদুল ফিতরেও গ্রামে ফিরতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এখন লকডাউন চলছে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি সীমান্তবর্তী জেলায়।
বিধিনিষেধের আওতায় থাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ট্রাক ভাড়া করে ঢাকায় আসার পথে সম্প্রতি ২১ জন আটক হন
লকডাউন বা বিধিনিষেধ নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। বিশেষ করে জনমনে সরকার সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে পারেনি বলে অভিযোগ অনেকের। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। মাস্ক পরিধান, স্বাস্থ্যবিধি মানা, লকডাউন পরিস্থিতিকে আমলে না নেয়ার মতো ঘটনা করোনার ভয়াবহতা বাড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্যক্তি অসচেতনতার অন্যতম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে অধিক সংক্রমিত এলাকা থেকে মানুষের অন্যত্র চলে যাওয়া। আর এমনটি ঘটেছে শুরু থেকেই। রাজধানী ঢাকাকে যখন প্রথমবার সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইল সরকার, তখন দেখা গেছে মানুষ পায়ে হেঁটেও গ্রামের বাড়ি ফিরছে। এই বাড়ি ফেরার সঙ্গে সবারই যে জীবন-জীবিকার তাগিদ ছিল, তা নয়। মূলত নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে গ্রামগুলো অরক্ষিত করেছে অসচেতন একটি গোষ্ঠী। ঈদের আগে অনেকে কেবল নিজের এবং নিজের ঘরের খুশির কথা ভেবে বাড়ি গেছে, ভাবেনি আশপাশের কারও কথাই। অনেকের মধ্যে কেবল নিজে সুস্থ থাকার বাহাদুরিও কাজ করেছে, যেজন্য ঘরের বয়স্ক লোক বা পাশের জনের চিন্তা করেনি তারা। এসব কারণেই অধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সংকটের এই ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। রাজধানীতে যখন লকডাউন, তখন বিধিনিষেধ অমান্য করে মানুষ গ্রামে ছুটল। আবার সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ যখন লকডাউন, তখন সেখানকার মানুষ রাজধানী বা অন্য এলাকায় যেতে মরিয়া। এদের অনেকেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সংক্রমিত এলাকা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে যেন। আর তাতে ঘনীভূত হচ্ছে বিপর্যয়।
করোনাকালে ঘরে থাকার প্রচারণা সত্ত্বেও বন্ধ করা যায়নি বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি-আড্ডাবাাজি
কেন এমন হচ্ছে, জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারের ঈদে লকডাউন দেয়া হয়েছিল পরিস্থিতি বিবেচনা করেই। কারণ তখন ঢাকায় করোনার প্রকোপ বাড়ছিল। অথচ মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে গেল। লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন তুলল। ঈদের পর প্রকোপ বাড়বে, কতিপয় লোকের অসচেতনতার কারণেই এমনটি ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। তা-ই হচ্ছে এখন। মানুষ কেন স্বাস্থ্যবিধি মানছে না বুঝতে পারছি না। হয়ত মানসিক পরিবর্তন থেকেই এমন করছে, যা সবার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমলানির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থায় সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছায় না। করোনা মহামারির প্রথম থেকেই সমন্বয়হীনতা ছিল। লকডাউন নিয়েই নানা প্রশ্ন ছিল। মানুষ কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অথচ দেশে বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারতেন। সরকার তা করেনি। আর এ কারণেই মানুষ দায়িত্বহীন আচরণ করছে এই মহামারির সময়েও।’
এএসএস/এইচএ/এমকেএইচ