করোনায় সরকারি কাজে হোঁচট
করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম পর্যায় কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। লকডাউন বা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এ অবস্থায় হোঁচট খাচ্ছে সরকারি কর্মকাণ্ড।
করোনার হানায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি কমে গেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হারও নিম্নগামী।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারাও গেছেন। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি দফতরগুলোর বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির আওতায় যে কাজগুলো করার কথা, সেগুলো নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মন্ত্রিসভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হারও কমেছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে গেলেও কোনো কাজ থেমে নেই। কাজে হয়তো কিছুটা ধীরগতি এসেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, কাজকর্মে প্রশাসন যেটুকু পিছিয়েছে, তা পূরণে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে যেতে থাকলে প্রথমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। গত বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি চলে। পরে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে দেয়া হয়, চালু করা হয় গণপরিবহন। পরে এই ব্যবস্থা তিন দফায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ফের উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন দেয় সরকার। তবে এর মাঝে গণপরিবহন ও মার্কেট খোলা রাখায় ওই লকডাউন ছিল অনেকটাই অকার্যকর।
পরে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়। লকডাউনের মধ্যে পালনের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরে ধারাবাহিকভাবে বিধিনিষেধে কিছু পরিবর্তন এনে তিন দফায় লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৬ মে মধ্যরাতে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রূপকল্প ২০২১ চলছে। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আছে, সেটা ২০২৪ সাল নাগাদ। এসডিজি’স গোল হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ। যে টার্গেটগুলো আছে সেগুলো সময়মতো অর্জন করতে হবে। কিন্তু সবার মতো আমরাও তো করোনা মহামারির মধ্যে পড়েছি। এরপরও আমরা চাইব, সময়মতো লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জন করতে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিন্তু থেমে নেই, কাজ কিন্তু চলছে। নদী খনন, খাল খনন, টিআর, কাবিখা চলছে। মানুষ যাতে বেকার না থাকে। ভার্চুয়ালিও অনেক কাজ চলছে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধ বিধিনিষেধের কারণে মানুষ অনেক সময় বাইরে বের হতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কাজ কিছুটা তো স্লো হবেই। সেটা যাতে পরবর্তী সময়ে পুষিয়ে নেয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপও থাকবে।’
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমরা ঠিক করব আমরা কতটুকু পিছিয়ে আছি, সেটুকু পূরণে তখন পরিকল্পনা নেয়া হবে।’
করোনার প্রভাবে চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মন্ত্রিসভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার গত বছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৬৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
মন্ত্রিসভা বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে ২০২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গত ৩ মে মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
এ সরকার দায়িত্ব নেয় ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৬ দশমিক ১২ শতাংশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়নের হার কমে হয়েছে ৮০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকাশিত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মাসিক ভিত্তিতে এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে গত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম সাত মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার সর্বনিম্ন। এই সময়ে এডিপিতে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার ৬০৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, অর্থাৎ বাস্তবায়ন হার ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাস্তবায়ন হার ছিল ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সংশোধিত এডিপির বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
করোনার প্রকোপ ঠেকাতে বিধিনিষেধে অন্যান্য খাতের মতো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প। বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশি পরামর্শক-প্রকৌশলী-কর্মীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া, মালামাল আমদানি করতে না পারা, কর্মীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া, রিসোর্স স্থানান্তর করতে না পারাসহ নানা জটিলতায় পড়ে প্রকল্পগুলো। ফলে প্রকল্পের গতি মুখ থুবড়ে পড়ে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতেও ধস নামে।
কাজ বন্ধ না থাকলেও লকডাউনে সঙ্কটে পড়েছে ১ হাজার ৭২৪ উন্নয়ন প্রকল্প। সেই সঙ্গে চলতি অর্থবছরে যেসব নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেসব প্রকল্পের অগ্রগতিতেও ভাটা পড়েছে।
করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতেও (এপিএ)। এটি গত অর্থবছরের মূল্যায়ন প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। চলতি অর্থবছরও এপিএতে করোনায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক বছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কি কাজ করবে তার একটি অঙ্গীকারনামা হচ্ছে এপিএ বা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। এই অঙ্গীকার পূরণ করবে বলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো অধীন দফতর বা সংস্থাগুলোর সঙ্গে এপিএ করে।
সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করা হচ্ছে।
অন্যান্য সময় এই অনুষ্ঠানটি জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে চলতি অর্থবছরের অনুষ্ঠানটি পিছিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে করা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির অর্জিত গড় নম্বর ছিল ৮৬ দশমিক ৫। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়নের হার কমেছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫১টির মধ্যে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগই ৮০-এর উপরে নম্বর পেয়েছিল। মাত্র সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ৮০-এর নিচে নম্বর পায়। পরের অর্থবছর (২০১৯-২০) ৩২টি মন্ত্রণালয় ৮০-এর ওপর নম্বর পেয়েছে, ৮০-এর নিচে পেয়েছে ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। চলতি অর্থবছর বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে করোনা বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করেছে।
একটি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন সংক্রান্ত কমিটির টিম লিডার (অতিরিক্ত সচিব) নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এবার চুক্তিই হয়েছে একটু দেরিতে। এখন তো জরুরি কাজগুলো চলছে শুধু। লক্ষ্য ও প্রকৃত কাজের মধ্যে হয়তো ঘাটতি থাকবে।’
সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনা-সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রতি বছর জুলাই মাসে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন করা হলেও করোনার কারণে গত বছর তা সম্ভব হয়নি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবারও অনিশ্চয়তা রয়েছে রাষ্ট্রীয় এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি নিয়ে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলা প্রশাসক সম্মেলন মানে হচ্ছে একটা বড় ধরনের গ্যাদারিং। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তো এটা করা যাবে না। তবে আমরা আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি রাখছি। সময় আসলে তখন বোঝা যাবে।’
আরএমএম/এমএইচআর/এসএইচএস/এমকেএইচ