‘লকডাউন ভাঙার প্রতিযোগিতায়’ রাজধানীবাসী
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম দফার কঠোর লকডাউন শেষ হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় আরও এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের সুপারিশ করে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। ২২ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফার লকডাউন যা শেষ হবে ২৮ এপ্রিল। তবে তার আগেই রাজধানীর অধিকাংশ সড়কে লক্ষ করা গেছে পুলিশের ঢিলেঢালা ভাব।
আজ থেকে খুলে দেয়া হয়েছে দেশের সব দোকানপাট, শপিংমল এবং সব ধরনের মার্কেট। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মার্কেট খোলা রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু মার্কেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে সড়কে যেন আনঅফিসিয়ালি লকডাউন শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে পূর্বের চিরচেনা সেই যানজট। এ যেন লকডাউন ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন রাজধানীবাসী।
দোকানপাট ও শপিংমল খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সড়কে যানবাহনের পাশাপাশি বেড়েছে মানুষের উপস্থিতিও। কঠোর বিধিনিষেধের তিনদিন বাকি থাকলেও রাজধানীতে যেন স্বাভাবিক হতে চলেছে সবকিছুই। প্রথম দফার প্রথম তিন-চার দিন মুভমেন্ট পাস না নিয়ে যেমন কেউ বের হননি, সেই চিত্র এখন ঠিক উল্টো। বেশিরভাগ মানুষই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে দেখা গেছে এবং বেশিরভাগই মুভমেন্ট পাস না নিয়েই বের হয়েছেন। মোটরসাইকেলে একজন আরোহন করার কথা না থাকলেও যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করতেও দেখা গেছে বেশিরভাগ মোটরসাইকেলে। মোড়ে মোড়ে ডেকে যাত্রীও নিচ্ছেন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকরা।
রোববার (২৫ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, ঢাকা উদ্যান, ধানমণ্ডি, বাংলামোটর, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, কাকরাইল, মিরপুর, গাবতলী, পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, গুলশান, বনানী ও মহাখালী ঘুরে চিত্র দেখা যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও প্রাইভেটকারের অবাধ চলাচল। এছাড়া ফুটপাত ও অলি-গলিতে মানুষের উপস্থিতিও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
চেকপোস্টগুলোয় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তল্লাশি করা হচ্ছে না মুভমেন্ট পাস। কে জরুরি কাজে আর কে অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের হয়েছে, তা দেখা হচ্ছে না।
সড়কে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন, আজ থেকে সব দোকানপাট, শপিংমল এবং মার্কেট খোলার কারণে রাজধানীর সব সড়কে যানবাহন ও মানুষের চাপ বেড়েছে। গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি না দেয়ায় সিএনজি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারে মার্কেট, কর্মস্থল ও প্রয়োজনীয় কাজে যাচ্ছেন মানুষ। এ কারণে একসঙ্গে সবাইকে মুভমেন্ট পাস আছে কি না কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সড়কে বেশিরভাগ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে লক্ষ করা গেছে।
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক কারওয়ান বাজার মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হঠাৎ করে গত কয়েকদিনের চেয়ে আজ সড়কে গাড়ি ও মানুষের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ হয়তো আর ঘরে থাকতে চাইছে না। মার্কেট খুলে যাওয়ার কারণে মানুষ বাইরে আসছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তাতে সামনের দিকে আরও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সন্দেহজনক মনে হলে আমরা গাড়ি চেক করছি। যারা যাতায়াত করছে তারা মুভমেন্ট পাস নিয়ে জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত করছে কি না সেটিও দেখছি। তবে গাড়ির ভিড়ে সবাইকে চেক করা সম্ভব হচ্ছে না।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিরপুর থেকে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এলাম। ভেবেছিলাম লকডাউন চলছে রাস্তায় গাড়ি কম দ্রুত পৌঁছানো যাবে। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে দেখি প্রচুর গাড়ি, মোড়ে মোড়ে পুলিশের সিগন্যালে আটকে থাকতে হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ।’
মোহাম্মাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শপিং মল এবং সব ধরনের মার্কেট খোলার কারণে সড়কে গাড়ির চাপে হঠাৎ করে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লকডাউনের শুরু থেকে যেভাবে পুলিশের চেকপোস্ট ছিল এখনও চেকপোস্ট রয়েছে। তবে মানুষের চাপে চেকপস্টে সবাইকে চেক করা সম্ভব হচ্ছে না।’
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকরা নিয়ম না মেনেই সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। বিধিনিষেধের আগে যেভাবে ডেকে যাত্রী ওঠাতেন এখনও একই কায়দায় মোটরসাইকেলে যাত্রী নিচ্ছেন তারা। যদিও বিধিনিষেধ চলাকালে মোটরসাইকেলে যাত্রী চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তায় কেউ নিয়ম মানছেন না। তাহলে তারা ঘরে বসে আর কী করবেন? যেহেতু মানুষ ঘর থেকে বের হয়েছে তাই তারাও বের হয়েছেন।
রিকশাচালক মঞ্জু মিয়া জানান, লকডাউনের কয়টা দিন রাস্তায় রিকশা নিয়ে নামলেই পুলিশ ঝামেলা করত। এই কয়টা দিন যাত্রী কম থাকায় ভাড়াও কম হয়েছে। তবে আজকে যাত্রী অনেক, মোটামুটি ভাড়াও পাচ্ছি।
তিনি বলেন, প্রতিদিন তিনবেলায় ঘরে দেড়শ টাকার চাল আর তরকারিসহ প্রায় আড়াইশ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মতো গরীব মানুষ এই লকডাউনে যদি ঘরে বসে থাকে তাহলে খাবার দেবে কে? কোনো উপায় না দেখে নিজেকেই রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
ধানমন্ডির গ্রিন রোডের চায়ের দোকানদার সবুজ আলী জাগো নিউজকে বলেন, আগের লকডাউনে শুধু চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চলতে হয়েছে। এতদিন রোজগার করে সেই সুদের টাকা পরিশোধ করছিলাম। আবার লকডাউনে সেই রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশের ভয়ে দোকান খুললেও দিনে কিছু টাকা আয় হয় কিন্তু দোকান খোলা দেখলেই পুলিশ এসে বন্ধ করে দিত এতদিন।
টিটি/এমএইচআর/এমএস