ফাঁসিতেই সাকার সমাপ্তি
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর।
শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার রায় কার্যকর করা হয়।
এর আগে দুপুরে প্রাণভিক্ষা চেয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের কাছে আবেদন করেন তিনি। রাষ্ট্রপতি তার প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিলে রাত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষ তার ফাঁসি কার্যকর করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের করা রিভিউ আবেদন গত বুধবার খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রসঙ্গত, বিচার চলাকালে নানা মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে সব সময় আলোচনায় ছিলেন সাকা চৌধুরী। বিচারকের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, আসামির কাঠগড়ায় বসে বিচারকাজ, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা, আইনজীবীকে বাদ দিয়ে নিজেই মামলা পরিচালনা করা। বিচার চলাকালে এজলাসে এমন বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।
এর আগে সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে সাকা চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামেও।
তদন্ত সংস্থা জানায়, রায় ঘোষণা হবে জানার পর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বসবাসের এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, রাউজান, পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও বোয়ালখালী এই পাঁচটি থানা সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট এলাকা।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও ভুক্তভোগীরা এসব এলাকায় বসবাস করেন। এ জন্য এসব এলাকার নিরাপত্তা বিশেষভাবে বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বা বিচার শেষ হওয়া যেকোনো মামলার তুলনায় এটি সবচেয়ে বড় কলেবরের মামলা।
২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩টি অভিযোগ গঠন করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০টি অভিযোগ ছিল জামায়াতের নেতা সাঈদীর বিরুদ্ধে।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের নয়টি গণহত্যার। মুক্তিযুদ্ধকালে রাউজানের মধ্য গহিরা, জগৎমল্লপাড়া, উনসত্তরপাড়া, শাকপুরা প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যা ছাড়াও সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অন্যতম আলোচিত অভিযোগ কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুসারে, একাত্তরের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরীতে নিজ বাসভবনে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সাকা চৌধুরী ছিলেন এবং তিনি নিজেও হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।
সর্বাধিক অভিযোগের মতো সর্বাধিক সাক্ষীও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। মোট সাক্ষী ছিলেন ৪৫ জন। গত বছরের ১৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। প্রায় সোয়া এক বছর ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণকালে রাষ্ট্রপক্ষে একে একে সাক্ষ্য দেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সালেহ উদ্দিনসহ কয়েকজন ভুক্তভোগী ও শহীদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূরুল ইসলামকে দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে ৪১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ১৩ জুন।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এক হাজার ১৫৩ জন সাক্ষীর দীর্ঘ তালিকা জমা দিয়েছিলেন তার আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনাল ওই তালিকা থেকে পাঁচজনকে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেন। আসামিপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আসামি সাকা চৌধুরী নিজেই। পরে তার পক্ষে আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন।
সাকা চৌধুরী দাবি করেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান; এরপর ঢাকায় ফিরেছেন ১৯৭৪ সালে। আসামিপক্ষের অন্য সাক্ষীরাও একই ধরনের জবানবন্দি দেন।
দুই পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গত ২৮ জুলাই যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। সাকা চৌধুরীকে অপরাধী দাবি করে সর্বোচ্চ সাজার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি এবং তাঁকে নিরপরাধ দাবি করে খালাসের জন্য আসামিপক্ষের পাল্টা যুক্তি শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট।
এসএ/জেইউ/এআর/এফএইচ/এমএএস/আরআইপি