ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

সাকার সনদ জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৫:১৬ এএম, ১৯ নভেম্বর ২০১৫

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী শেষ মুহূর্তেও আদালতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তিনি এমন সনদ দাখিল করেছেন, যার সঙ্গে তার আগের পেশ করা কাগজপত্রেই রয়েছে অনেক গরমিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশে ছিলেন না-এই মিথ্যাটি প্রমাণ করতে শেষমেশ জাল সনদ দাখিল করেও ধরা পড়ে গেছেন আদালতের কাছে।

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গত ১৬ নভেম্বর আপিল বিভাগে পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সনদ দাখিল করেন সাকা। গতকাল (বুধবার)এ বিষয়ে শুনানি হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। শেষ পর্যন্ত ওই সনদ আমলে নেননি আদালত। এ বিষয়ে আগে দাখিল করা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রশংসাপত্রই কাল হয় তার জন্য। ওই প্রশংসাপত্র আর মূল সনদপত্রের মধ্যে ব্যাপক অমিল খুঁজে পান আদালত।

আপিল বিভাগে শুনানির সময় ওই সনদের বিষয়ে আসামির আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে লক্ষ্য করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আপনি (সাকা চৌধুরী) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আপনি বাংলাদেশে ছিলেন না-এই একটি মিথ্যাকে ধামাচাপা দিতে এতগুলো অনিয়মের আশ্রয় নিলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দাখিল করা এই সনদ বিশ্বাসযোগ্য নয়।’

অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এর পক্ষে সাফাই সাক্ষীদের বক্তব্য এফিডেভিট আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছিলাম। কিন্তু অথেনটিকেশনের কারণে তা বিশ্বাস করেনি ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগে শুনানিকালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপকের টেস্টিমনিয়াল (প্রশংসাপত্র) আদালতে দাখিল করেছিলাম। তখন আপনারা (আপিল বিভাগ) বলেছিলেন এত ডকুমেন্ট দাখিল করতে পারলেন, মূল সার্টিফিকেট কোথায়? এরপর আমরা মূল সনদ পেয়েছি। তাই এটা দাখিল করেছি।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সালাউদ্দিন কাদের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন বলছেন। আদালতে আপনাদের দেয়া সার্টিফিকেটটি দেখলাম। এই সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয় ২০১২ সালে, আর এটা দাখিল করছেন এখন। আপিলের শুনানিতে দাখিল না করে রিভিউ এর শুনানিতে দিলেন কেন?

জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, আমরা একই সঙ্গে মূল সার্টিফিকেট (সনদ) ও টেস্টিমনিয়ালের জন্য আবেদন করেছিলাম। যেহেতু সনদ পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই আগেই টেস্টিমনিয়াল দাখিল করা হয়েছিল। এরপরই আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তারা জানায় যে, মূল সার্টিফিকেট প্রস্তুত হয়েছে। এরপর তা সংগ্রহ করে রিভিউ এর শুনানিকালে দাখিল করেছি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো কারাগারে, তাহলে এটা জোগাড় করলেন কিভাবে? নিয়ম অনুযায়ী ছাত্রকেই তো সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে হয়। সার্টিফিকেট ওঠানোর জন্য যে তিনি আবেদন করেছেন, এ ধরনের কোনো তথ্য এখানে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, ঠিকই বলেছেন। আমি কারাগারে। তাই আমার পক্ষে কেউ সেটা জোগাড় করেছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সার্টিফিকেট আনতে হলে দূতাবাসের মাধ্যমে আনতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো সিল-স্বাক্ষর কিছু নেই কেন?’

জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, একটি বিপরীত পরিস্থিতিতে এসে আমাদেরকে এই মামলা পরিচালনা করতে হয়েছে। এখন অ্যামবেসিতে সার্টিফিকেট দিলেই তারা সত্যায়িত করার ক্ষেত্রে কতটুকু সহযোগিতা করবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে এই পর্যায়ে সনদ আসল না নকল সেই বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক হলে অ্যামবেসির মাধ্যমে তা আদালত যাচাই করতে পারেন। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল আছেন, তার প্রতিনিধির মাধ্যমেও এটা যাচাই করতে পারেন। আমি বলছি, এটা আসল।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সার্টিফিকেট আসল না নকল তা যাচাই করার সময় কি এখন? গঙ্গার জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায় হয়েছে। আপিল বিভাগে শুনানিতে অনেক যুক্তিতর্ক শুনেছি। এরপর আপিল বিভাগের রায় হয়েছে। আপনারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন করলেন। বান্ডিল বান্ডিল নথিপত্র দিলেন। ওয়াশিংটন, লন্ডন থেকে ডকুমেন্ট আনতে পারলেন। তখনো দিলেন না। এখন এসে এটা দিচ্ছেন।’ এ পর্যায়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কখনো মিথ্যা বলো না। কারণ একটি মিথ্যা বললে তা ঢাকতে শত মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়।’

জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, আমার বক্তব্য হচ্ছে এই সনদ আসল। আমরা আপিল বিভাগে সাক্ষীদের অডিও রেকর্ড দিয়েছিলাম। তা আমলে নেননি। তিনি বলেন,‘যে পর্যায়েই দেয়া হোক না কেন, মূল সনদ এখন এসেছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপনারা এটা গ্রহণ করতে পারেন। এই সনদ বিবেচনায় নিলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী খালাস পেতে পারেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের সঙ্গে তাদের (পাকিস্তান) যুদ্ধ হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শুরু থেকেই এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে তারা। এমনকি তাদের জাতীয় সংসদে বিচার বন্ধে রেজল্যুশন পাস করা হয়েছে এবং তাতে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর রয়েছে। তাই সেখান থেকে যেসব নথি আসছে তার প্রত্যেকটিতে আমাদের সিরিয়াস সন্দেহ রয়েছে। সেখানকার রাষ্ট্রপতিও যদি সনদ দেন তারপরও সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’

প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আপনি যেসব ডকুমেন্টস দিয়েছেন তাতে দেখছি অসংগতি রয়েছে। এখন যে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন, তাতে গ্রেডিং সিস্টেমের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ওই সময় তো গ্রেডিং বা সেমিস্টার সিস্টেম ছিল না। অনার্স ছিল ইয়ারভিত্তিক।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনা সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করেছেন, সেটা ২০১২ সালে ইস্যু করা হয়েছে। ২০১৩ সালে তিনি যখন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন তখন বলেছেন, তিনি কোনো শিক্ষাগত সনদ দাখিল করেননি।

তিনি আরো বলেন, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির কথা বলেছেন সালাউদ্দিন কাদের। আমিও একই সময়ে ওই বিভাগের ছাত্র ছিলাম।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি বা ক্রেডিট ট্রান্সফারেরও সুযোগ ছিল না। টেস্টিমনিয়ালে সেশন দেখানো হয়েছে ১৯৭০-৭১, আর সার্টিফিকেটে উল্লেখ রয়েছে সেশন ১৯৭১। সালাউদ্দিন কাদের ১৯৭১ সালে পরীক্ষা দিয়েছেন। সেই হিসাবে তখন যদি দুই-তিন বছরের সেশন হয় তাহলে তার সেশন হবে ১৯৬৮ বা ৬৯। তাই এই সার্টিফিকেট নকল। এটি আদালতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তিনি বলেন, বিদেশ থেকে কোনো ডকুমেন্ট আনতে হলে তার একটা নিয়ম আছে। নোটারি পাবলিক দিয়ে এফিডেভিট করতে হবে। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এটা করতে হয়। এরপর তাতে হাইকমিশনার অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাউন্টার সাইন (প্রতিস্বাক্ষর) থাকতে হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই সনদে এ রকম কিছু নেই। পাকিস্তানে আমাদের হাইকমিশনার সেখানে স্বাক্ষর করেননি। কাউন্টার সাইন নেই। আইনের দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

প্রধান বিচারপতি মূল সনদ দেখিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেনকে বলেন, এখানে ১৯৭১-এর ১৯ বড় করে লেখা, আর ৭১ এত ছোট কেন? এটা সন্দেহজনক। টেস্টিমনিয়ালে সেশন লেখা আছে ১৯৭০-৭১। আর মূল সার্টিফিকেটে সেশন লেখা আছে ১৯৭১। কোনটি বিশ্বাসযোগ্য? তবে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।

জেডএইচ/আরআইপি/এআরএস