গোরখোদকসহ কেউ ভোলেননি সাগর-রুনিকে
সাগর-রুনির কবর দুটি কোন দিকে বলতে পারেন? আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের দক্ষিণ দিকের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে পাশেই একটি কবরের পরিচর্যকারী মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে এ প্রশ্ন করতেই তিনি পাল্টা জানতে চাইলেন সাংবাদিক সাগর-রুনির কবরের কথা জানতে চাইছি কি-না।
মাথা নাড়াতেই তিনি আঙ্গুল উঁচিয়ে দুটি গাছ দেখিয়ে বললেন, পাশাপাশিই দুজনের কবর। কবরস্থানে সংস্কার কাজ চলছে তাই এ রাস্তায় যেতে পারবেন না। একটু ঘুরে ওই গাছের কাছে গেলেই কবর দুটি পেয়ে যাবেন।
এ সময় গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় শুনে তিনি কিছুটা ক্ষোভ, অবজ্ঞা ও হতাশার সুরে বললেন, আপনারা এত মার্ডারের নেপথ্যে খবর দেন অথচ গত নয় বছরেও আপনাদের এ দুজন সাংবাদিক খুনের রহস্য বের করতে পারলেন না। ওই ব্যক্তি এও জানতে চাইলেন, সাগর-রুনির ছোট্ট ছেলে মেঘ কত বড় হয়েছে।
সংক্ষেপে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কিছুটা পথ ঘুরে দেখিয়ে দেয়া গাছের তলায় যেতেই চোখে পড়ে পাশাপাশি দুটি সাদা মোজাইক পাথরে আচ্ছাদিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতির কবর। সবুজ ঘাসের গালিচায় আচ্ছাদিত দুটি কবর। সাগর ও রুনির সাদা মোজাইক কবরের মাথার কাছের কিছু মোজাইক ভাঙা চোখে পড়ে। মেহেরুন রুনির মাথার পাশে একটি ছোট্ট ফুল গাছ , গাছে দুটি সাদা ধবধবে ফুলও ফুটে আছে।
গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় শুনে একাধিক গোরখোদক এবং কবরের আগাছা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পানি ছিটানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিক এসে বলেন, কবরস্থানে প্রতিদিন এত এত মরদেহ দাফন হয়, কত আত্মীয়স্বজন এসে কবরের খোঁজ করেন কিন্তু তারা বলতে পারেন না। তবে নয় বছর আগে দাফনকৃত সাংবাদিক সাগর ও রুনির কবর তারা এক নামেই চিনেন।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় সাধারণ মানুষ হিসেবে তারাও হতাশ বলে জানান।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়। এরপর নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয় ডিবি। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে একই বছরের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার ৮ আসামির দুজন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে আছেন। অপর ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিল ও আবু সাঈদ কারাগারে আটক আছেন। আসামিদের মধ্যে তানভীর জামিনে আছেন। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার ৮ জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেনি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেয়। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান এ পাঁচ জনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এ পর্যন্ত ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
কিন্তু নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ৭৮ বারেও দাখিল করতে পারেনি র্যাব।
মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান জাগো নিউজকে বলেন, দেশে অনেক হত্যা মামলার বিচার হয়। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচার হয় না। নয় বছরেও মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি র্যাব। মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি আমাদের জানানো হয় না। হত্যাকাণ্ডের নয় বছরেও মামলাটির বিচার না হওয়ায় হতাশ আমাদের পরিবার। আমরা বিচারের আশায় পথ চেয়ে আছি।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত রয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এ বিষয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন।
এমইউ/এসজে/এএসএম