রাজধানীর রাস্তায় পিঠার দোকান, বিক্রির আয়ে চলে সংসার
বিকেল থেকে দিনের আলোয় কাজ করেছেন। আর সন্ধ্যা নামতেই কৃত্রিম আলো জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আলো জ্বালানো হলে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পিঠা বিক্রির ভ্যানের কাছেই ক্রেতারা অপেক্ষা করছেন। রাজধানীর টিএসসি এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের গেটেই এভাবে এক পিঠা বিক্রেতাকে দেখা গেল। এই টিএসসি এলাকাতেই চারজন পিঠা বিক্রেতার দেখা পাওয়া যায়।
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ কয়েকটি জেলায় শীতের প্রকোপ থাকলেও রাজধানীতে শীতের তীব্রতা তেমন নেই। ভোররাত থেকে কুয়াশার সঙ্গে কিছুটা শীত অনুভব করা যায়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতা কমতে থাকে। তারপরও শীতের এই আমেজকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় পিঠা। পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির এক অংশ। শীতের সকালে পিঠা খাওয়া গ্রামের চিরায়ত দৃশ্য হলেও এমন দৃশ্য রাজধানীতেও চোখে পড়ে। ব্যস্ত রাজধানীর শহুরে জীবনে ঘরে পিঠা তৈরি করা কষ্টসাধ্য হলেও ভ্রাম্যমাণ দোকানে পিঠা পাওয়া যায়। তাই শীত মৌসুমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পিঠার দোকান গড়ে ওঠে।
এ বছরও শীতকে ঘিরে রাজধানীর মৌসুমি পিঠা বিক্রেতাদের প্রস্তুতির কমতি নেই। দিনভর পিঠার আটাসহ অন্য উপকরণ তারা তৈরি করেন। আর বিকেল হলেই রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হরেক রকমের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাত ১০টা পর্যন্ত সেই পিঠা বিক্রি চলে। আর পিঠা বিক্রির আয়েই এসব খেটে খাওয়া মানুষের সংসার চলে। বলা যায়, শীত মৌসুমে তিন মাস পিঠা বিক্রি করেই তারা উপার্জন করে থাকেন।
রাজধানীর পল্টন, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, সেগুনবাগিচা, রামপুরা, মালিবাগ, নতুনবাজার, কারওয়ান বাজার ও শাহবাগের টিএসসি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিকেল থেকেই পিঠা বিক্রেতারা রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেন। কেউ ভ্যানে করে আবার কেউ নির্দিষ্ট স্থানেই শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করেন। পিঠা বিক্রির টাকায় এ স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর সংসার চলে। শীত শেষ হলে রিকশা চালানো কিংবা অন্য কোনো দিন মজুরির কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন তারা।
এ দলে নারীরাও রয়েছেন। এসব নারীরা সারাবছর বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তবে এবার করোনার কারণে অনেকেই বাসাবাড়ির কাজ হারিয়েছেন। আবার অনেকেই কাজ না পেয়ে স্বামী সন্তান সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় পিঠা বিক্রি করছেন। এসব নারীদের কারোর স্বামী নেই আবার স্বামী থাকলেও অসুস্থ। তাই সংসার চালাতে শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করছেন। এসব দোকানে শীতের বিভিন্ন প্রকারের পিঠা দেখা যায়। এর মধ্যে ভাপা আর চিতই পিঠার দোকানই বেশি চোখে পড়ে।
নগরীতে সন্ধ্যা নামতেই পিঠার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে। অনেক সময় একজনের পক্ষে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়। একাধিক চুলায় পিঠা তৈরি করেও ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ কঠিন হয়ে যায়। এ সময় পিঠা বিক্রেতা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধও করেন। অনেকে বাড়ির সদস্যদের জন্যও পিঠা নিয়ে যান। আর বেশিরভাগ ক্রেতাই গরম পিঠা খাওয়ার জন্য দাবি করেন বলে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়। এসব পিঠার দোকানে রিকশাচালক থেকে শুরু করে দিনমজুর, শিশু-কিশোর, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী সব শ্রেণি-পেশার মানুষই আসেন। পিঠা বিক্রেতারা জানান, চালসহ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হলেও পিঠার দাম বাড়েনি।
টিএসসির পিঠা বিক্রেতা সবুজের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার এখানে দুই ধরনের ভাপা পিঠা তৈরি করা হয়। ঝালের ভাপা আর গুড়ের ভাপা পিঠা। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একশ থেকে ১৫০টি পিঠা বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন একইরকম বিক্রি হয় না। কোনোদিন একশটি পিঠাও বিক্রি করা কঠিনে হয়ে যায়। এখন তো সবখানেই পিঠা পাওয়া যায়।
পিঠার দামের বিষয়ে এ বিক্রেতা বললেন, সাধারণত ১০টাকা দামেই পিঠা বিক্রি করি। কেউ কেউ ২০ টাকার পিঠার কথা বললে সেটাও তৈরি করি। তবে ১০টাকার পিঠাই বেশি বিক্রি করি। দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হলে পাঁচ থেকে সাতশ টাকা লাভ থাকে। কোনো কোনো দিন আবার পাঁচশ টাকাও হয় না।
রামপুরার ওয়াপদা রোডের কাছে এক নারী পিঠা বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, শীতের সময় তিন মাস পিঠার চাহিদা থাকে। দুই মাস ধরে ভাপা ও চিতই পিঠা বিক্রি করছি। আর একমাস হয়তো পিঠা বিক্রি করা যাবে। চাল ও গুড়ের দাম বাড়লেও পিঠার দাম একই আছে বলেও জানান তিনি।
অন্য সময় কী করেন প্রশ্নে এ নারী পিঠা বিক্রেতা বললেন, বাসাবাড়িতে কাজ করি। তবে সবসময় তো কাজ পাই না। তাই ছোট মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় এই কাজ করে সংসার চলছে। শীত শেষ হলে হয়তো কিছু একটা করে চলবো, আল্লাহ যেভাবে রাখেন।
কারওয়ান বাজার এলাকার পিঠা বিক্রেতা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। যখনই কোনোকিছু করে আয় করার সুযোগ আসে তখনই তাই করতে হয়। শীতের সময় কমবেশি সবাই পিঠা খায়। তাই পিঠা বিক্রি করি। যা আয় হয় বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা কয়েকজন শিক্ষার্থী পিঠা খেতে এসেছেন। টিএসসিতে পিঠার দোকানের সামনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, সন্ধ্যা হলেই বাইরে বের হই আমরা। টিএসসিতে আসলে চাসহ অনেককিছুই খাওয়া হয়। এখন শীতের সময় গ্রামে থাকলে ভাপা পিঠা খাওয়া হতো। কিন্তু সে সুযোগ নাগরিক জীবনে নেই। তাই এই পিঠার দোকানই শেষ ভরসা। পিঠা ভালো লাগলে যে যার মতো করে আমরা পিঠা খাই। তারপরও বাড়িতে তৈরি পিঠার স্বাদ এখানে পাওয়া যায় না।
পরিবারের জন্য পিঠা কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গ্রামে থাকলে মায়ের হাতের পিঠা খেতাম। কিন্তু এ ঢাকাতে সেই সুযোগ আর কোথায়। প্রায়ই সহকর্মীদের সঙ্গে শীতের সময়ে নগরীতে পিঠা খাওয়া হয়। আজ পরিবারের সদস্যদের জন্য পিঠা নিচ্ছি। তবে শঙ্কার বিষয় হলো- এখন ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছে, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি তো থাকেই। তবে পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা বলতে পারেন।
কলেজ পড়ুয়া তিন বন্ধু পিঠা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। গরম ধোঁয়া ওঠা একটা পিঠা দিতেই তিন বন্ধু কাড়াকাড়ি করে খেতে থাকে। তাদের সঙ্গেও কথা হয়। বললেন, বন্ধুদের সঙ্গে এভাবে পিঠা খাওয়ার মুহূর্ত আমরা উপভোগ করি।
এওয়াইএইচ/এমআরআর